যেভাবে এলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রাচীন ধর্মীয় উৎসব জন্মাষ্টমী। একটা সময় ছিল, যখন ঢাকাবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন এ উৎসবের শোভাযাত্রা করার।
বর্তমানে এ ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকলেও সেই জৌলুস আর নেই। জন্মাষ্টমী উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকার আয়োজিত শোভাযাত্রা বিখ্যাত ছিল বাংলায়।
শ্রাবণ বা ভ্রাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আর তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ দিনটি পূণ্যের, উৎসবের।
এদিন শ্রীকৃষ্ণ পাপ দমন ও ধর্মসংস্থাপনের জন্য দেবকী বাসুদেবের পুত্ররূপে কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, এ দিনে শুধু উপবাসেও সপ্ত জন্মকৃত পাপ বিনষ্ট হয়। তাই এদিনে তারা উপবাস করে লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করেন। আর কালের বিবর্তনে এ আরাধনার অংশ হয়ে ওঠে মিছিল ও শোভাযাত্রা।
ঠিক কবে থেকে এবং কেন শোভাযাত্রা জন্মাষ্টমীর অংশ হয়ে ওঠে, তার নির্দিষ্ট ইতিহাস জানা যায় না। তবে লেখক ভুবন মোহন বসাক এবং যদুনাথ বসাকের দুটি বই থেকে শোভাযাত্রার পুরনো ইতিহাস সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারণা পাওয়া যায়।
বই দুটির একটি ১৯১৭ সালে এবং অপরটি ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয়। দুটি বইতে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জন্মাষ্টমী উৎসবে শোভাযাত্রার শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকে।
ভুবন মোহনের লেখা বই অনুসারে ইসলাম খাঁর ঢাকা নগরের পত্তনের (১৬১০ সাল) আগে বংশালের কাছে এক সাধু বাস করতেন। ১৫৫৫ সালে (ভাদ্র ৯৬২ বাংলা) তিনি শ্রী শ্রী রাধাষ্টমী উপলক্ষে বালক ও ভক্তদের হলুদ পোশাক পরিয়ে একটি মিছিল বের করেছিলেন। এর প্রায় ১০-১২ বছর পর সেই সাধু ও বালকদের উৎসাহে রাধাষ্টমীর কীর্তনের পরিবর্তে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে আরো জাঁকজমকপূর্ণ একটি মিছিল বের করার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল। সে উদ্যোগেই ১৫৬৫ সালে প্রথম জন্মাষ্টমীর মিছিল ও শোভাযাত্রা বের হয়।
পরে এ শোভাযাত্রার দায়ভার এসে বর্তায় ঢাকার নবাবপুরের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী কৃষ্ণদাস বসাকের ওপর। কালক্রমে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা একটি সাংগঠনিক রূপ নেয়, প্রতিবছর জন্মাষ্টমী উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় শোভাযাত্রা। শোনা যায়, কৃষ্ণদাস স্বপ্নে ‘শ্রী শ্রী বলরাম মূর্তি’ দর্শন করেন এবং প্রত্যাদেশ বাক্য প্রতিপালনের জন্য মদন মোহন বিগ্রহ আনেন।
পরে তিনি শ্রী শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ চক্রসহ বিগ্রহটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১০৪৫ বঙ্গাব্দে কৃষ্ণ দাসের মৃত্যুর পর থেকে শ্রী শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ চক্রই এ উৎসবের আয়োজন শুরু করেন। তারা ধীরে ধীরে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রাকে আরো উন্নত করে তোলেন।
এরপর থেকে নবাবপুরের অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও জন্মাষ্টমী উপলক্ষে নিজ নিজ শোভাযাত্রা বের করতে শুরু করেন। কালক্রমে যা পরিচিত হয়ে উঠে ‘নবাবপুরের মিছিল’ নামে।
অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে ইসলামপুরের পান্নিটোলার কিছু ব্যবসায়ী ধনাঢ্য হয়ে উঠেন এবং সামাজিক মর্যাদা রক্ষার্থে তারাও জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা বের করতে শুরু করেন।
জেমস টেলর’র লেখনি থেকে জানা যায়, ১৭২৫ সালে জন্মাষ্টমী পালনের জন্য দুটি পক্ষের সৃষ্টি হয়। নবাবপুর পক্ষকে বলা হতো লক্ষ্মীনারায়ণের দল আর ইসলামপুর পক্ষকে বলা হতো মুরারি মোহনের দল। সপ্তদশ শতকে শোভাযাত্রার শুরু হলেও তা বিকশিত হয়েছিল ঊনিশ শতকের শেষার্ধে, বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ধারা বলবৎ ছিল।
প্রথমদিকে মিছিলে নন্দঘোষ, রানী যশোদা, শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে আনা হতো। ক্রমেই এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে আরো নানা অনুষঙ্গ। তবে মূল কাঠামোটি ছিল প্রথমে নেচে-গেয়ে যাবে কিছু লোক, এরপর দেব-দেবীর প্রতিমা, লাঠিসোটা, বর্শা, সিশান ইত্যাদি নিয়ে বিচিত্র পোশাক পরিহিত মানুষের মিছিল এবং নানা রকম ঐতিহাসিক দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি- ঠিক যেন মিশরীয়দের প্যাশন প্লে।
সে সময় থেকেই শোভাযাত্রায় কাগজ, রং, মোম, চুমকি ইত্যাদির ব্যবহার ছিল। মিছিলের প্রধান আকর্ষণগুলো ছিল সুসজ্জিত হাতি, ঘোড়া, রঙিন কাগজে মোড়ানো বাঁশের টাট্টি, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মন্দির, মঠ, প্রাসাদ, দূর্গ ইত্যাদি প্রস্তুত ও প্রাচীন কীর্তির প্রদর্শন। সেসব আয়োজন এখন শুধুই স্মৃতি। কিন্তু, হাজার প্রতিকূলতার পরও ঢাকায় এখনো জন্মাষ্টমী উৎসব ও শোভাযাত্রা জাঁকজমকপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন



















