যেভাবে শুরু হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের পথচলা
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সূচনালগ্ন ছিল ১৯৭৮ সালে, একটি ক্ষুদ্র পাঠচক্র হিসেবে।
ঢাকা কলেজের পেছনে শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের (বর্তমানে নায়েম) ছোট্ট মিলনায়তনটিতে ওই পাঠচক্রটি শুরু হয় বছরের একেবারে শেষের দিকে। সদস্য ছিলেন মাত্র ১৫জন। সেই পাঠচক্রে ঠিক হয় যে প্রতি সপ্তাহে তারা প্রত্যেকে একটি নির্ধারিত বই বাড়িতে নিয়ে পড়বেন।
পরের সপ্তাহের নির্ধারিত দিনে সেখানে এসে ওই বই নিয়ে আলোচনা হবে।
পাঁচ বছর পর এই পাঠচক্রের সাফল্য দেখে এটি স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার কথা ভাবতে শুরু করলেন প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
তখন ঢাকা কলেজের শিক্ষক মি. সায়ীদ শিক্ষকতার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে হাত দিলেন, যেটি কিশোর-তরুণদের মাঝে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বার্তা নিয়ে যাবে।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের শুরু সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছেন, আমি শিক্ষক মানুষ। একজন শিক্ষক যেভাবে এমন পরিস্থিতির জবাব দেয়ার কথা ভাবতে পারেন, আমি সেভাবেই ভাবলাম … প্রথমেই আমাদের ভাবতে হয়েছিল, কী কী উপায়ে আমাদের কিশোর-তরুণদের চিত্তকে আলোকিত করে বড় জীবনের স্বপ্ন ও আদর্শে উদ্বদ্ধু করে তোলা যায়। আমাদের মনে হয়েছিল দুইটি ব্যাপার এই লক্ষে বড় অবদান রাখতে পারে।
১. তাদের মন-বয়সের উপযোগী শ্রেষ্ঠ ও অনিন্দ্যসুন্দর বইগুলো পড়িয়ে তাদের জীবনকে অনুভূতিময় সুন্দর ও উচ্চ মূল্যবোধ সম্পন্ন করে তোলা।
২. পড়ার পাশাপাশি সুস্থ সাংস্কৃতিক কর্মসূচির ভেতর দিয়ে তাদের বড় করে তোলা।
তিনি লিখেছেন, ”আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে মাত্র ১০ জন তরুণ ও তাদের জন্য দশটি বই কেনার দাম বাবদ এক ভদ্রলোকের কাজ থেকে পাওয়া ৩৪টি টাকা সম্বল করে শুরু হয়েছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের যাত্রা। সেই সভ্য সংখ্যা আজ ২৮ লক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।”
প্রতিষ্ঠানটি ৮ই ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার তাদের ৪০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান করছে।
এই পাঠচক্র শুরুর কিছুদিন পরে ইন্দিরা রোডে একটি বাসা ভাড়া করে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় মূলত তাঁর শুভানুধ্যায়ী-আত্মীয়-ছাত্ররা সহযোগিতা করতেন। কিছু কিছু সরকারি সহায়তাও পাওয়া যাচ্ছিল।
কয়েক বছর পরে ঢাকার বাংলামোটরে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ পায় কেন্দ্র। তখন সেটি আনসারের সদরদপ্তর হিসাবে ব্যবহৃত হতো।
এই বাড়িটি বরাদ্দ পাওয়ার পর ইন্দিরা রোডের ভাড়া বাসা ছেড়ে এখানে উঠে আসে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। এখানে একটি লাইব্রেরী স্থাপন করা হয়। এখান থেকে পড়া এবং পাঠচক্রগুলো পরিচালিত হতো।
১৯৮৪ সালে সারা দেশের স্কুল কলেজে বই পড়া ও উৎকর্ষ কর্মসূচি নামের একটি বই পড়া কার্যক্রম শুরু করে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। এর নিয়ম ছিল – শিক্ষার্থীরা ১৬টি বই নিয়ে পড়ে শেষ করবে এবং ফেরত দেবে। পরে সেসব বইয়ের বিষয় ধরে একটি পরীক্ষা হবে। সেখানে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়দের পুরস্কার হিসাবে দেয়া হবে বই।
এ রকম সময়ে এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন বিতার্কিক ও উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার।
তিনি লিখেছেন, ”ইন্দিরা রোডের ভাড়া করা বাসা থেকে আজকের বহুতল ভবন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের এই চার দশকের যাত্রা মসৃণ ছিল না। অর্থাভাব ছিল, যথেষ্ট মানুষ ছিল না। ধার করে, প্রায় ভিক্ষা করে স্যার টাকা এনে কেন্দ্র চালাতেন। কিন্তু আমি একবারও তাকে আশা হারাতে দেখিনি।”
”যখন বই পড়া শুরু হয়, পুরস্কারের বই থেকে মাইক – সব তার দুই দরজার ভঙ্গুর পাবলিকা গাড়ি পেছনে নিয়ে আমরা দুজন যাত্রা করতাম। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা বলতেন।”
বিবিসি বাংলাকে আবদুন নূর তুষার বলছেন, ”বই পড়া, বই বিতরণ নেটওয়ার্কের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করতাম আমি। তখন আমি কলেজে পড়ি। আমরা যা করতাম – বন্ধুরা মিলে ভাগ করে স্কুলে স্কুলে গিয়ে বই দিতাম, আবার আগের বইগুলো ফেরত নিতাম।”
”পুরস্কার দেয়ার দিন স্যারের গাড়ির পেছনে পুরস্কারের বই, মাইক ইত্যাদি নিয়ে যেতাম। স্যার নিজেই গাড়ি চালাতেন, আমি তাঁর সঙ্গে যেতাম। স্যারের গাড়িটা মাঝে মাঝে নষ্ট হতো, তখন নেমে সেটা ঠেলতে হতো। তাই কেউ তাঁর সঙ্গে যেতে চাইতো না।”
”আবার স্যার খুব আস্তে গাড়ি চালাতেন। তখন আমাদের মধ্যে একটা গল্প চালু ছিল – স্যার গাড়ি চালাচ্ছেন, তখন একটা গাড়ি তাকে অতিক্রম করে গেল, এরপরে একটা অটো অতিক্রম করে গেল, এরপরে একটা রিক্সাও তাকে ছাড়িয়ে গেল। তারপরেই স্যার একটা ট্রাককে অতিক্রম করে ফেললেন, তবে ট্রাকটা থামানো ছিল।”
বাংলামটরের বর্তমান ঠিকানায় তখন ছিল ছোট একটি দোতলা বাড়ি। সেখানে একটি লাইব্রেরি ছিল এবং মিলনায়তন ছিল।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে মি. তুষার বলছেন, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা অনুদানের মাধ্যমে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। টাকা-পয়সা সংগ্রহে অনেক ঘাটতি ছিল। কেন্দ্রের লোকজন অনেকে কয়েক মাসের বেতন পেতেন না। আবার টাকা জোগাড় হলে তখন সবাইকে একসঙ্গে দিয়ে দেয়া হতো।
তবে বই পড়া কর্মসূচিটি খুব জনপ্রিয়তা পায়। এরপরে পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচী, জাতীয় ভিত্তিক লাইব্রেরি কার্যক্রম, আলোর ইশকুল, ভ্রাম্যমাণ বইমেলা ইত্যাদি প্রকল্প শুরু করে কেন্দ্র। তখন দেশি-বিদেশী সহায়তাও আসতে শুরু করে।
এখন কেন্দ্রীয় ও ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরিসহ ২,১০০ স্কুল ও কলেজে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রম চলছে, যার নিয়মিত পাঠক সংখ্যা ২ লক্ষ ১৭ হাজার। আর মোট সদস্য সংখ্যা ২৮ লক্ষ।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন