যেসব কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে আগ্রহ কমছে শিক্ষার্থীদের। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ, সাত সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত, ঢাকার বাইরে স্থায়ী ক্যাম্পাস, কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধার অভাব, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়াসহ নানান কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমছে। পুরাতন-নতুন সব বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থী কমছে। তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই শিক্ষার্থী সংকট বেশি। কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে ভর্তির সংখ্যা বাড়লেও গত বছরে প্রায় ১৩ হাজার শিক্ষার্থী কমে গেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। অপরদিকে শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখিতাও বাড়ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৬’ তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমার চিত্র উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাশাপাশি জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাবমূর্তির সংকটেও পড়েছে। এসবের প্রভাব শিক্ষার্থী ভর্তিতে পড়তে পারে। দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য এটি গভীর সংকট।
বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সহ-সভাপতি ও ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, চার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে।
তার মতে প্রথম কারণটি হলো- সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি সরকারি কলেজ অনর্ভুক্ত হওয়ায় অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে সেসব কলেজে ছুটছে।
দ্বিতীয়ত, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর হওয়ায় ঢাকা থেকে দূরত্ব বেড়ে গেছে। এখন শিক্ষার্থীরা সেসব স্থানে ভর্তি হচ্ছে না।
তৃতীয়ত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো মানের শিক্ষকদের দিয়েই অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে। স্থায়ী ক্যাম্পাসের দূরত্ব বাড়ায় শিক্ষকরাও সেখানে গিয়ে পড়াতে আগ্রহী না হওয়ায় কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
চার নম্বর কারণ হিসেবে অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বলেন, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার প্রতি ১৫০ জনের বেশি ভর্তি না করতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কড়া নির্দেশনা থাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ভর্তি সংখ্যা কম দেখাচ্ছে। এসব কারণে শিক্ষার্থী কমছে।
ইউজিসির প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৫ সালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার ১৩০। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৩৭ হাজার ১৫৭ জনে।
নতুন চারটিসহ গত বছর শিক্ষার্থী ভর্তি করে ৮৬টি বিশ্ববিদ্যালয়। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই ৩০টিতে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে শিক্ষার্থী কমেছে। প্রথম সারির বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এ তালিকায়।
দেশে প্রথম সারির পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি)। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়েও গত বছর শিক্ষার্থী কমেছে। ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী ছিল মোট ১০ হাজার ৩৪৪ জন। ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ৫৯৫ জনে। এ হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়তে শিক্ষার্থী কমেছে ৭৪৯ জন।
এদিকে ২০১৫ সালে বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ৫৭২। গত বছর শিক্ষার্থী কমে দাঁড়িয়েছে নয় হাজার ২৭৪ জনে। গত বছর এখানে এক হাজার ২৯৮ জন শিক্ষার্থী কমে গেছে।
২০০৬ সালে রাজধানীর শ্যামলীতে গড়ে ওঠা আশা বিশ্ববিদ্যালয়েও কমেছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ২০১৫ সালে শিক্ষার্থী ছিল দুই হাজার ৯৭১ জন। ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৪৭৩ জনে। এক বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থী কমেছে প্রায় পাঁচশ জন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ডালেম চন্দ্র বর্মণ বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ে বিশেষায়িত অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় আবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা রয়েছে, যেটা আমাদের নেই। এছাড়া যোগ্য শিক্ষকের একটি বড় সংকট রয়েছে। অনেক সময় খণ্ডকালীন শিক্ষকের ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে।
১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে কমেছে পাঁশ শিক্ষার্থী। ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চার হাজার ৬১৬ জন শিক্ষার্থী থাকলেও গত বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১২৪ জনে।
এক হাজার তিনশ’র বেশি শিক্ষার্থী কমছে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে। ইউজিসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চার হাজার ৪৬১ জন শিক্ষার্থী থাকলেও গত বছর তা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ৬৬ জনে।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। ২০১১ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থী ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার ৮২২। পরের বছর এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় তিন লাখ ১৪ হাজার ৬৪০। ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৩ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ২৮ হাজার ৭৩৬, ২০১৪ সালে তিন লাখ ৩০ হাজার ৭৩০ ও ২০১৫ সালে সাড়ে তিন লাখ। ২০১৬ সালে এসে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির এ ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে।
যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমেছে :
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কমার তালিকায় রয়েছে গণবিশ্ববিদ্যালয়, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, সিটি ইউনিভার্সিটি, প্রাইমইউনিভার্সিটি, সাদার্ন ইউনিভার্সিটি, বিইউবিটি, ইউআইটিএস, প্রাইমেশিয়া, ভিক্টোরিয়া, ইস্ট ডেল্টা ও অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখিতাও বাড়ছে :
কয়েক বছর ধরে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখিতাও বাড়ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে মোট ৩৩ হাজার ১৩৯ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এর আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ২৪ হাজার ১১২। এ হিসাবে এক বছরে বিদেশগামী শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে নর্দান ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) বিভাগের অধ্যাপক ইউসুফ মো. আবু আব্দুল্লাহ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সহজলভ্য হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন কলেজে ভর্তি হচ্ছেন। সেখানে কম খরচে ও কম পরিশ্রমে সার্টিফিকেট মিলছে বলেই অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী হচ্ছে না। আবার ভালো মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে উপচেপড়া ভিড় থাকছে।
তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন আইন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হুমকির মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেখানের সমস্যাগুলো নির্ণয় করে তা সমাধানে এগিয়ে আসছে না। এ কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষার আদলে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে। এ কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষার জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমানভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।-জাগো নিউজ
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন