যেসব কারণে সিজারিয়ান বাড়ছে বাংলাদেশে


বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রসব সিজারিয়ান বা সি-সেকশনে করানোর সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও৷ কিন্তু বাংলাদেশে সেই সীমা ছাড়িয়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে৷


দিন দিন বাড়ার জন্য সিজারিয়ান বেসরকারি ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা, সরকারি ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু না হওয়া এবং ডাক্তারদের নৈতিকতার ঘাটতিকে দায়ী করছেন গবেষকরা৷

অনেক সময় বাধ্য হয়ে সিজারিয়ান করানোর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর বড় রকমের অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে বলে উঠে এসেছে আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায়৷

ওই গবেষণায় উঠে আসে বাংলাদেশে বিভিন্ন পরিবার সম্ভবত তাদের আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ খরচ করছে বাচ্চা প্রসবের ক্ষেত্রে৷ কাউকে কাউকে ঋণ করে কিংবা সঞ্চয় ভেঙেও এই খরচ করতে হচ্ছে৷

ওই গবেষণায় দেখা গেছে, সিজারিয়ানের ক্ষেত্রে তাদের গড়ে খরচ পড়ছে ২৫০ ডলার, সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের ক্ষেত্রে যে খরচ মাত্র ৬০ ডলার৷

এভাবে বাচ্চা প্রসবে খরচ বৃদ্ধি বাংলাদেশের ‘ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার’ অর্জনে বড় বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় ওই গবেষণায়৷

বাংলাদেশে সিজারিয়ান নিয়ে আইসিডিডিআর,বির ওই গবেষণা দলের প্রধান ডা. আবদুর রাজ্জাক সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাড়িতে ডেলিভারি করা হলে মাত্র ১৪শ টাকা খরচ হয়৷ যখন সরকারি ইনস্টিটিউশনে ডেলিভারি করা হয়, সেখানে গড়ে ৬ হাজার ৬০০ টাকা খরচ হয়৷ যখন সি-সেকশন করতে হয়, তখন এই খরচটা গড়ে ২১ হাজার টাকা হয়ে যায়৷ এটা মানুষের উপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করছে৷”

২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিজারিয়ান প্রসবের সংখ্যা শতকরা ৩১ ভাগ, যা বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত হারের দ্বিগুনেরও বেশি৷ তাদের নির্ধারিত হার অনুযায়ী, এই সংখ্যা হতে পারে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ৷

নানা কারণে সিজারিয়ানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল৷

‘প্রাইভেট ক্লিনিকের অর্থলিপ্সা’

প্রাইভেট ক্লিনিকের অর্থলিপ্সার কারণে বাংলাদেশে সিজারিয়ানের সংখ্যা বাড়ার কথা জানান চিকিৎসক কাজল৷ ‘‘সিজারিয়ান বাড়ার প্রথম কারণটা কিন্তু অর্থনৈতিক৷ ৯৫ ভাগ ক্লিনিকের আয়ের উৎস সিজারিয়ান অপারেশন,” ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-২০১৪ (বিডিএইচএস)-এর এক তথ্যানুযায়ী, দেশে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে সিজারিয়ান পদ্ধতিতে৷ এক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে৷ সমাজে সবচেয়ে শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে৷ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান এবং সচ্ছল পরিবারে এই হার অনেক বেশি৷

সিজারিয়ানের সংখ্যা কমানোর জন্য চিকিৎসকদের বিবেক জাগ্রত করার উপর গুরুত্ব দিয়ে ডা. কাজল বলেন, ‘‘চিকিৎসকদের বিবেক যদি না জাগে, এটা বন্ধ করা যাবে না৷ আর ক্লিনিকগুলোতে সিজারিয়ান অপারেশনগুলো মনিটরিংও করতে হবে৷ কেন করল, অন্য উপায় নিয়েছে কিনা, সেটা দেখতে হবে৷ মাসে সে কতগুলো সিজারিয়ান করল কোন ক্লিনিক প্রভৃতি৷”

একইসঙ্গে সরকারি হাসপাতালে বিশ্বাসযোগ্যতায় আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে রেটটা অনেক কম৷ সরকার চেষ্টা করছে, নার্স রেখে, মিডওয়াইফ রেখে, তাদেরকে প্রণোদনা দিয়ে স্বাভাবিক পথে ডেলিভারি করতে উদ্বুদ্ধ করতে৷”

‘প্রথমবারের ফাঁদে মায়েরা’

ক্লিনিকগুলোর ফাঁদে পড়ে কিংবা চিকিৎসকদের অসাবধানতায় প্রথমবার সিজারিয়ান করার ফলে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের সময় বাধ্য হয়েই আগের পথে হাঁটতে হচ্ছে বলে মনে করেন ডা. কাজল৷

‘‘প্রথমবার যখন কারো সিজারিয়ান অপারেশন করে ফেলে, তখন বাধ্য হয়েই দ্বিতীয়বার সন্তান প্রসবের সময় সিজারিয়ান করতে বাধ্য হচ্ছে ডাক্তাররা৷ কারণ, যদি প্রসব বেদনার সময় হাসপাতালে সব ধরনের সুবিধা না থাকে, তাহলে দ্বিতীয়বার সিজারিয়ান ছাড়া প্রসবের ঝুঁকি নেয়া যায় না,” ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷

‘‘প্রথমবার যেহেতু লক্ষ লক্ষ মায়ের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান হয়ে গেছে, তখন দ্বিতীয় বাচ্চার ক্ষেত্রেও তাদের সিজার হবে৷ সে কারণে রেটটা দিন দিন বাড়তে থাকবে৷ এমন একটি চক্রের মধ্যে পড়েছি আমরা৷”

প্রথমবার সিজারিয়ানের পর দ্বিতীয়বার স্বাভাবিক প্রসবে ঝুঁকি ব্যাখ্যা করে ডা. কাজল বলেন, ‘‘কোনো কারণে প্রসব বিলম্বিত হলে মায়ের জরায়ু ফেটে যেতে পারে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন না করলে মায়ের মৃত্যু হতে পারে৷ এই বিপদের কারণে বিদেশে সিজারিয়ান রোগীকে দ্বিতীয়বার স্বাভাবিকভাবে প্রসবের ঝুঁকি নিলেও সুবিধা না থাকায় বাংলাদেশে নেওয়া সম্ভব হয় না৷”

শিক্ষিতদের মধ্যে সিজারিয়ানের হার বেশি

আইসিডিডিআর,বির গবেষণায় উঠে এসেছে, ৩৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সি মায়েরা অন্যদের তুলনায় বেশি খরচ করছেন৷ অন্যদিকে, শহুরে নারীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত এবং জন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানেন, তাঁরাও এই বেশি খরচের পথই ধরছেন৷

সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব হেলথ প্ল্যানিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে আইসিডিডিআর,বির ওই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে৷

মায়েদের মধ্যে প্রসব নিয়ে ভীতি কাজ করাকে সিজারিয়ান বাড়ার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করছেন চিকিৎসক কাজল৷ ‘‘আমাদের মায়েরা রিস্ক নিতে চায় না৷ এ কারণে হাসপাতালগুলোতে প্রসূতি মায়েদের জন্য ২৪ ঘন্টা একই মানের সেবা থাকতে হবে,” ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷

মানুষের মধ্যে সিজারিয়ান নিয়ে ভীতি আছে বলে মনে করছেন অনেকে৷ ‘‘গ্রামে ভীতি তৈরি হয়েছে৷ অনেকে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যায় না৷ তারা বলে, আমি গেলেই তো সিজার করে দেবে,” বলেন চিকিৎসক কাজল৷

‘‘এই যে একটা ভুল মেসেজ এবং ভীতি ঢুকে গেছে, এটা খুবই খারাপ৷ আমরা চাচ্ছি, শতভাগ মা গর্ভকালীন সময়ে আমাদের পরিচর্যায় থাকুক৷ কিন্তু এই একটা ভীতি তৈরি হচ্ছে, গেলেই তো আমার সিজার করে দেবে৷ এই একটা ভীতি ঢুকে যাচ্ছে, এটা যে কত খারাপ ঘটনা চিন্তা করার মতো না৷”