যে কারণে থমকে রমনায় বোমা হামলা বিচার
পয়লা বৈশাখে রাজধানীর রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় করা মামলার বিচারের প্রথম পর্যায় শেষ হতে পার হয়ে গেছে ১৪ বছর। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিচার প্রক্রিয়া হাইকোর্টে যাওয়ার পর পার হয়েছে আরো প্রায় চার বছর। চাঞ্চল্যকর এ মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের পাশাপাশি আসামিরাও হতাশায় ভুগছেন।
একবার শুনানি শেষ হলেও রাষ্ট্রপক্ষের সময়ক্ষেপণের কারণে মামলাটির নিষ্পত্তি হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। তাঁদের দাবি, এ মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতির কারণে বিলম্ব হচ্ছে।
অন্যদিকে আসামিপক্ষের অভিযোগ অস্বীকার করে রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে, আদালত পরিবর্তনের কারণে হাইকোর্টে মামলাটি থমকে আছে।
সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের শুরুতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে মামলাটির শুনানি শুরু হলেও পরে সেটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে মামলাটি শুনানির জন্য হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
এ বিষয়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি আরিফ হোসেন সুমনের আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি বলেন, ‘হাইকোর্টে মামলাটি আপিল ও ডেথ রেফারেন্স হিসেবে শুনানির জন্য আসার পর সাবেক প্রধান বিচারপতি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এটি শুনানির নির্দেশ দিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের বেঞ্চে ঠিক করে দেন। এরপর মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হয়।’
আসামিদের পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন, সুজিত চ্যাটার্জি, মোহাম্মদ আলী শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফরহাদ হোসেন ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানি করেন। এরপর শুনানি প্রায় সমাপ্ত হয়ে যায়।
এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তাঁর কিছু অসমাপ্ত বক্তব্য প্রদানের জন্য ছয় সপ্তাহ সময় নেন। এর পর থেকে তিনি আর শুনানিতে অংশ নেননি। তাঁর পক্ষে শুধু সময় আবেদন করা হয়। একপর্যায়ে এসে আদালত বিরক্ত হয়ে মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন বলে দাবি করেন আইনজীবী সুজিত চ্যাটার্জি।
আইনজীবী আরো বলেন, ‘এর পর থেকে দীর্ঘদিন মামলাটি পড়ে আছে। বর্তমানে মামলাটি হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ বিচারপতি রুহুল কুদ্দস ও ভীষ্মদেব কুমার চক্রবর্তী বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন প্রধান বিচারপতি। গতকাল ১২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ১৭ নম্বরে ছিল। কিন্তু আর শুনানি হয়নি। এতে করে আসামিদের মধ্যেও হতাশা বাড়ছে।’
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে দ্রুত এ মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে বলে দাবি করছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আদালত পরিবর্তনের কারণে হাইকোর্টে মামলাটি থমকে আছে। আশা করছি, দ্রুত শুনানি শেষ হবে।’
মামলার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালে বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সর শুনানির জন্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে অপেক্ষমাণ রয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারির দিকে একবার শুনানি হলেও শেষ পর্যায়ে এসে আর শুনানি হয়নি। পরে হাইকোর্ট মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এখন আদালতের বেঞ্চ পরিবর্তনের কারণে মামলাটি আবার নতুন করে পুনরায় শুনানি করতে হবে। কবে নাগাদ তা শেষ হবে, তা জানা যায়নি।
এ মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ও ফৌজদারি মামলা বিশেষজ্ঞ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিলম্বিত বিচারের কারণে ন্যায়বিচার-বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা আছে। রাষ্ট্রপক্ষের সদিচ্ছা ও উদ্যোগ থাকলে মামলাটি বহু আগে শেষ হয়ে যেত। কিন্তু বিশেষ কোনো কারণে মামলা শেষ করা হচ্ছে না। অথচ এর চেয়ে বড় বড় মামলাও অনেক স্বল্প সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ শেষ করার নজির রয়েছে।’
মামলার বিবরণে জানা যায়, রমনা বোমা হামলার ঘটনায় ১৪ বছর পর ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দায়রা জজ আদালত মুফতি আবদুল হান্নানসহ আট জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হাইকোর্টে চলমান রয়েছে। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি আড়াই বছর পর ২০১৭ সালের ৮ জানুয়ারি শুরু হয়। তবে দীর্ঘ চার বছর পার হলেও এখনো শুনানি শেষ হয়নি।
এ মামলার প্রধান আসামি মুফতি হান্নানকে এরই মধ্যে অন্য একটি মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অন্য আসামিদের বিচার চলমান রয়েছে।
এদিকে এ ঘটনায় দুটি মামলার মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন রয়েছে। এ মামলা এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ওই মামলার চার আসামি এখনো পলাতক।
মামলাটির বিচারকাজ দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকার বিষয়ে ঢাকার মহানগর রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, একটি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ায় বারবার সমন দেওয়া সত্ত্বেও সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিতে আসছে না। এতে বিচার বিলম্ব হচ্ছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রাজধানীর রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালায় জঙ্গিরা। তাতে ১০ জন নিহত হন। আহত হন আরো অনেকে। ওই ঘটনার ১৪ বছর পর ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দায়রা জজ আদালত মুফতি হান্নানসহ আট জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন হুজি নেতা মুফতি আবদুল হাই, মুফতি শফিকুর রহমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মাওলানা আকবর হোসাইন ও আরিফ হাসান। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন পলাতক। এ ছাড়া এ মামলায় হুজির আরো ছয় জঙ্গিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য এই মামলার নথি ডেথ রেফারেন্স আকারে হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি মুফতি হান্নানসহ কারাবন্দি আসামিরা আপিল দায়ের করেন। আপিলে তাঁরা মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় বাতিল চান।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এসব ডেথ রেফারেন্স ও আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় মামলার পেপার বুক করার নির্দেশ দেন। এরপর এই মামলার পেপার বুক প্রস্তুত করা হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন