যে কারণে সেদিন জঙ্গিদের টার্গেট ছিল আদালতপাড়া
অন্যান্য কর্মদিবস থেকে ব্যতিক্রম ছিল না ক্যালেন্ডারের পাতার ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট। দিনটি ছিল বুধবার। প্রতিদিনের মতোই সকালে ঘুম থেকে উঠে জীবিকার তাগিদে দেশের কর্মজীবী মানুষ ছুটেছিলেন যার যার কর্মক্ষেত্রে। অফিস-আদালত ছিল কর্মচাঞ্চল্য। কলকারখানাগুলোতেও কাজে ব্যস্ত ছিলেন শ্রমিকরা। হাট-বাজারে চলছিল নিয়মিত বেচাকেনা। স্কুল-কলেজেও চলছিল ক্লাস। খবর পরিবর্তন ডটকমের সৌজন্যে।
হঠাৎই সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে মাত্র আধ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে বিকট শব্দে কেঁপে উঠে সারাদেশ। মুন্সিগঞ্জ বাদে দেশের ৬৩ জেলায় বোমা হামলার খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাংলার প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে। এমন ঘটনা ইতিহাসে এর আগে কখনোই কেউ শোনেননি, দেখেনও নি। সবার চোখ তখন টিভি পর্দায়, ব্রেকিং নিউজ আসছে চ্যানেলগুলোতে। স্ক্রলে দেখাচ্ছে বোমা বিস্ফোরণে আক্রান্ত জেলাগুলোর নাম।
মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় দেশের মহাসড়কগুলো। মানুষজন কর্মক্ষেত্র থেকে নিরাপদ আশ্রয় পেতে যে যার বাড়ির দিকে ছুটে, ফাঁকা হয়ে যায় অফিস-আদালত-ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। স্বাধীনতার পর দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ছিল এটি। নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিতে সেদিন ৬৩টি জেলার ৪০০ স্পটে প্রায় ৫০০ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি। এ হামলায় নিহত হন ২ জন এবং আহত হন দুই শতাধিক মানুষ।
সেদিন জঙ্গিদের টার্গেট ছিল হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, জেলা আদালত, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেসক্লাব ও সরকারি-আধা সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। আর অধিকাংশ স্থানেই রিমোর্ট কন্ট্রোলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল, যা ছিল জঙ্গিদের হাতে বানানো।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে দীর্ঘ ১৩ বছরে ৯৪টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এই মামলাগুলোতে ৩৩৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে। এখন ৫৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে, যার আসামি সংখ্যা ৩৮৬ জন। রায় প্রদান করা মামলাগুলোর মধ্যে ৩৪৯ জনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ২৭ জনের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাহ আলম তালুকদার বলেন, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মোট ১৮টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে দুটি মামলার রায় হয়েছে। ১১টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল এবং বাকি ৫টি মামলা বিচারের অপেক্ষায় আছে। বিচারাধীন এই মামলাগুলো আগামী জানুয়ারির মধ্যে শেষ করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
প্রচলিত বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল হামলাকারীরা
হামলার স্থানগুলোতে জেএমবির প্রচারপত্রও পাওয়া গিয়েছিল। প্রচারপত্রে তারা এ দেশে ‘আল্লাহর আইন’ বা শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করার দাবি জানায়। তারা দেশে বলবৎ আইনকে ‘তাগুতি আইন’ হিসেবে অভিহিত করে তা বাতিলের দাবি জানায়। লিফলেটে জঙ্গি সংগঠনটি বলে, ‘দ্রুত এ দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা হবে। প্রচলিত বিচারব্যবস্থা আমরা মানি না।’
সিরিজ বোমা হামলার সময় জেএমবির প্রধান ছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান, সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই। অন্য একটি মামলায় এই দুইজনসহ জেএমবির ছয় শীর্ষ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ। বাকি চার জঙ্গি হলেন- আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুক। পরে একই মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর জেএমবি নেতা আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কেন টার্গেট করা হয় আদালতকে?
আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ. ম. রেজাউল করিম বলেন, ‘কিছু উগ্র মৌলবাদী ব্যক্তি সাংবিধানিক বিধিবিধানে বিশ্বাস করে না, মানতেও চায় না। তারা নিজেদের মতো করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামাফিক বিচার করতে চায়। সে কারণে তারা আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদালত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই সম্মিলিতভাবে আঘাত হানতে ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছিল।’
সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরো বলেন, ‘এই সিরিজ বোমা হামলার প্রতিটি ঘটনাতেই আলাদা আলাদা মামলা হয়েছে। অনেক মামলাতেই অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। কোনো কোনো মামলার আসামিদের বিচার শেষে সাজাও হয়েছে। তবে সব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। প্রশাসনিক ও পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।’
সাংগঠনিক শক্তি হারিয়েছে জেএমবি
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আল-কায়েদার অনুসরণেই ১৯৯৮ সালে জেএমবির সৃষ্টি হয়। ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে তারা তাদের শক্তির জানান দিতে চেয়েছিল। ওই ঘটনায় অনেকের বিচার হয়েছে। এখনও জেলে রয়েছে শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা।
তিনি জানান, ওই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড় এবং জেএমবিকে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার ফলে সংগঠনটি কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির মাধ্যমে জেএমবির প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরুতে জেএমবির শীর্ষ নেতা মাওলানা সাইদুর রহমানকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টাকে নাসাৎ করে দেয়া হয়। পরে এই সংগঠনটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ভারতে পলাতক সালাউদ্দিন সালেহিন জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অপর একটি ভাগ নব্য জেএমবি নামে পরিচিত।
মনিরুল ইসলাম বলেন, তীব্র অভিযানের মুখে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ায় নতুন করে হামলা চালানোর সক্ষমতা হারিয়েছে জেএমবি ও নব্য জেএমবি। ছোটখাটো যেসব জঙ্গি এখনো পলাতক থেকে সক্রিয় রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন