যে তিন কারণে পরকীয়ায় জড়াচ্ছে নারীরা
ঢাকায় যানজট ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে। এ যানজটে পুরুষদের বাড়ির বাইরে অবস্থানের সময় বাড়ছে। এ কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে দাম্পত্য জীবন। স্বামী-স্ত্রী দীর্ঘক্ষণ আলাদা থাকায় কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে পরকীয়ায়। ভেঙে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন। আর এর বলী হচ্ছে তাদের সন্তানরা। প্রিয় মানুষরাই নির্মমভাবে হত্যা করছেন স্বজনদের। সমাজবিজ্ঞানী ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসবের নেপথ্য কারণ সম্পত্তি ও বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক।
চলতি সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর কাকরাইল ও বাড্ডায় জোড়া খুনের ঘটনা এমনটাই প্রমাণ করে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, যানজটের কারণে পুরুষদের মানসিক চাপও বাড়ছে। আর এ চাপের কারণে অনেকেই হারিয়ে ফেলছেন স্বাভাবিক যৌনজীবন। গভীর রাতে বাসায় ফিরে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত স্বামী কোনমতে খাবার খেয়েই এলিয়ে পড়ছেন বিছানায়। স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক দূরে থাক, স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার আগ্রহই হারিয়ে ফেছে স্বামীরা।
অপরদিকে স্ত্রীরাও সারাদিন বাড়িতে থেকে নিঃসঙ্গতায় ভুগতে থাকেন। আর এ থেকে পরিত্রাণ পেতে জড়িয়ে পড়ছেন পরকীয়ায়। এতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার- ইত্যাদি।
পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধ সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। পারিবারিক অস্থিরতা ও কলহের প্রভাব পড়ছে সমাজে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড। বাবা-মায়ের হাতে সন্তান হত্যার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি সন্তানের হাতে জন্মদাতা বাবা-মায়ের প্রাণহানিও ঘটছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী এবং স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন হওয়ার ঘটনাও কম নয়। এক ভাই খুন করছে অন্য ভাইকে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধের প্রধান শিকার নারী ও শিশু।
গত বুধবার রাতে রাজধানীর কাকরাইলে নিজ বাসায় গলা কেটে হত্যা করা হয় মা শামসুন্নাহার ও ছেলে শাওনকে। এ ঘটনায় পুলিশের সন্দেহ পারিবারিক কলহ থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। এর একদিন পর গতকাল সকালে রাজধানীর বাড্ডায় একটি ভবনের ছাদ থেকে বাবা ও মেয়ের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনায় নিহত প্রাইভেটকার চালক জামিল হোসেনের স্ত্রী আজরিনাকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে পরকীয়ার জের ধরেই আজরিনা তার স্বামী ও ৯ বছরের মেয়ে নুসরাতকে হত্যা করেছে।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রিন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আহসান হাবীব বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের মানুষের পারিবারিক মূল্যবোধ খুব শক্তিশালী। কিন্তু গত কয়েক বছরে পারিবারিক সহিংসতা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। বিশেষ করে শহুরে জীবন এখন ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ, যেটাকে বলা হচ্ছে ‘অ্যাপার্টমেন্ট কালচার’। যেখানে অন্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে না। এ কারণে সামজিকতাটা স্বাভাবিক থাকে না। তখন মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে। আবার সবাই ব্যস্ত থাকায় কেউ কাউকে সময় দিতে পারছে না। সব মিলিয়ে পারিবারিক মূল্যবোধের জায়গা খুব হালকা হয়ে গেছে।
সহিংসতা না ঘটা পর্যন্ত পরকীয়রি তথ্য ফাঁস হচ্ছে না। কিন্তু ঢাকায় অবরুদ্ধ জীবনে প্রায় প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এ ঘটনা সর্বনাশা রূপ নিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে বলঅ হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে মানসিক চাপের ১০টি শহরের মধ্যে একটি ঢাকা, যার প্রধানতম কারণ বলা হচ্ছে যানজট। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার অসহনীয় যানজট কেবল নগরবাসীকে মানসিকভাবে অসুস্থই করছে না, সেই সঙ্গে অপরাধপ্রবণ করে তুলছে।
কানাডার সেন্টার ফর ড্রাগ অ্যাডিকশন অ্যান্ড মেন্টাল হেলথের পরিচালক ডা. কাওমি ম্যাকেনজি তাদের একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলেন, যানজট এমন একধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, কেউ যদি এই চাপ নিয়মিত গ্রহণ করে তবে তার অস্থিরতা তিনগুণ বেড়ে যায়, বিষন্নতার ঝুঁকি বাড়ে ৫০ শতাংশ এবং যানজটের বিরক্তির প্রভাব পরিবারের ওপর পড়ে বলে সংসার ভাঙার ঝুঁকিও বেড়ে যায় ৫০ শতাংশ।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণা বলছে, যানজটে মানসিক চাপ এতটাই বেশি থাকে, কেউ যদি এই চাপের মধ্য দিয়ে ১০ বছর পার করে তবে তার মানসিক অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।
এসব গবেষণার ফলাফল যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা ঢাকাবাসী ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন। কেন না তাদের এখন প্রতিদিনই প্রচণ্ড মানসিক চাপে থাকতে হয় যানজটের কারণে।
প্রতিদিনের যানজটের অভিজ্ঞতার কথা বলেন কয়েকজন যাত্রী। এক যাত্রী বলেন, ‘প্রেসার বেড়ে যায়। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ি বাসায় গিয়ে।’ আরেকজন বলেন, ‘যখন বাসে উঠি মনে হয় হাসপাতালে আছি।’ তৃতীয় যাত্রী বলেন, ‘আমার প্রতিদিন কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা হয়। এটার জন্য আমার প্রতিদিন চার ঘণ্টা আরো বাড়তি খরচ করতে হয়।’ এক নারী যাত্রী বলেন, ‘চরম বিরক্তিকর অবস্থা থাকে, কখন জ্যামটা পার হব আর কখন বাসায় যাব এরকম লাগে।’ আরেকজন বলেন, ‘এটা আসলে সহ্য করার মতো না, অসহ্য।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি বাণিজ্যিক সংস্থা জিপজেট-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে মানসিক চাপের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান সপ্তম, যার মূল কারণটি বলা হয়েছে যানজট। ঢাকার যানজটজনিত এমন মানসিক চাপের বিষয়টি আরো আগেই টের পেয়েছেন মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যে রোগীগুলি পাই, হতাশা অথবা আগ্রাসী স্বভাব বা অন্যান্য বিরক্তিকর ইয়ে নিয়ে আসতেছে। তখন কিন্তু আমরা রোগ ডায়াগনসিস করি এবং আমরা তার পারসোনাল হিস্ট্রিগুলো চাই। আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, অনেকের কাছ থেকেই জানতে পারি, একটা প্রধান অন্যতম কারণ হচ্ছে যানজট। এ কারণে তারা বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত এবং ত্যক্তবিরক্ত।’
তিনি আরো বলেন, ‘যানজটের কারণে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বিরক্তি। লক্ষ্য করবেন যে, আমাদের সমাজে মানুষ খুব বেশি আগ্রাসী হয়ে যাচ্ছে। তারা আগের মতো ধৈর্যশীল বা শান্ত থাকতে পারছে না। এটার একটা অন্যতম কারণই হচ্ছে, মানে এ ধরনের বিরক্তির অভিজ্ঞতা প্রতিদিনই হতে থাকা যানজটের কারণে।’
মানসিক অসুস্থতার অন্যতম প্রধান কারণ মানসিক চাপ। এই মানসিক চাপের উৎস নানা কিছুই হতে পারে। তবে যানজট থেকে সৃষ্ট মানসিক চাপ তুলনামূলক অনেক বেশি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষক ও চিকিৎসকরা।
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. এম এ রশিদ বলেন, ‘যানজট যেটা আমি চোখের সামনে দেখছি, এত স্ট্রেসড হয়ে যাচ্ছে যে, তার ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। এই যে স্ট্রেস ফ্যাক্টর, এই স্ট্রেসের কারণে একটা মানুষ অফিসে একটা ভালো কথা শুনল, তার কর্মক্ষেত্রে, তার পরিবারের সাথে ভালো কথা শুনলেও দেখা যাচ্ছে সে উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন