যে বাঙালী ‘ভদ্রলোক’রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে গিয়েছিলেন
আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর এক মাস আগের ঘটনা।
অবিভক্ত ভারতের নদীয়ার বাসিন্দা মহিরুদ্দিন মন্ডল মারা গেলেন তৎকালীন মেসোপটেমিয়া বা বর্তমানের ইরাকে। সেই সময়ে তাদের অবস্থান ছিল বসরা শহরের দক্ষিণে।
তারও কয়েক মাস আগে ওই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল বগুড়ার ভোলানাথ চৌধুরী, ঢাকার জগদীশ চন্দ্র বসু, বর্ধমানের বগলাচরণ ব্যানার্জীএবং ময়মনসিংহের প্রমথনাথ ঘোষকে।
মহিরুদ্দিন মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই, ৩০ অক্টোবর, ১৯১৮ মেসোপটেমিয়ার যুদ্ধ শেষ হয় তুর্কি সেনাবাহিনীর পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে। আর তার কদিনের মধ্যেই ১১ নভেম্বর, ১৯১৮, শেষ হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
বাংলার নানা জেলা থেকে এদের মতো আরও অনেক তরুণ, যুবক গিয়েছিলেন সেখানে, যুদ্ধ করতে। পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদের নিয়ে গড়া হয়েছিল বেঙ্গলি রেজিমেন্ট।
আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘ফর্টিনাইনথ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট’।
এই ফর্টিনাইনথ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের হয়েই যুদ্ধে গিয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
আরও এক বহুল পরিচিত বাঙালীও এই রেজিমেন্টে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিশক্তি কম থাকায় তাকে বাহিনীতে ভর্তি করা যায় নি।
কয়েক দশক পরে অবশ্য সেই বাতিল হয়ে যাওয়া সৈনিকই ব্রিটিশ সরকারের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
তার নাম সুভাষ চন্দ্র বসু, ভারতের মানুষ যাকে নেতাজী বলে সম্মান দিয়ে থাকে।
বাঙালীদের তখনও লড়াকু, যোদ্ধা জাতি বলে মনেই করা হত না, তাই যখন যুদ্ধ বাধল ১৯১৪ সালে, তখন গোড়ার দিকে বাঙালীদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না ব্রিটিশ সরকারের।
বাঙালীদের নিয়ে সন্দেহ ছিল ব্রিটিশদের
যে বাঙালীরা যুদ্ধের ক’বছর আগেই বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পথে নেমেছিল, এবং যার শাস্তিস্বরূপ কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলেই ইতিহাসবিদদের অনেকে মনে করেন, সেই বাঙালীরা যুদ্ধের প্রশ্নে কী অবস্থান নেবে, তা নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল।
যদিও অন্যান্য প্রদেশ থেকে সেনাবাহিনীতে প্রচুর সংখ্যায় লোক নেওয়া হচ্ছিল বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই, দেশীয় রাজা-নবাবরা বিপুল পরিমানে অর্থ এবং লোকবল দিয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন ব্রিটিশ সরকারকে।
কিন্তু বাঙালীদের সেনাবাহিনীতে নেওয়ার কথা তারা মাথাতেই আনে নি।
ব্রিটিশ সরকার গোড়ায় শুধুমাত্র চিকিৎসা পরিষেবা, পরিবহন সেবার এবং সিগনালিংয়ের মতো কাজগুলিতে বাঙালীদের নিয়োগ করেছিল। কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে তাদের পাঠাতে আগ্রহ ছিল না।
এই সময়ে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এগিয়ে এলেন এই দাবী নিয়ে, যে বাঙালীদেরও সেনাবাহিনীতে নেওয়া হোক, তাদেরও পাঠানো হোক যুদ্ধে।
এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলে কংগ্রেস নেতা স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী। নিজের সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা ‘বেঙ্গলি’-তে তিনি লিখেছিলেন, “সরকারের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য থাকতেই পারে। কিন্তু শত্রুর সামনে সেইসব ঝগড়া, মতানৈক্য ভুলে মহান সাম্রাজ্যকে রক্ষায় যা কিছু আছে, তাই দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়া আমাদের কর্তব্য।”
স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর বই থেকেই উদ্ধৃত করে দক্ষিণ এশিয়ার সমর-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অশোক নাথ লিখছেন, “আমার ভাষণগুলোর মূল বিষয় ছিল, যে আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ভাবছেন, তার একটা মূল অঙ্গ হল আত্ম-সুরক্ষা। আমরা যদি রাজকীয় নাগরিকত্বের দাবী তুলি, তাহলে তার ভার ও দায়িত্বগুলোও আমাদের নিতে হবে। এই সময়ের সবথেকে গুরুদায়িত্ব হল সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা।”
সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে তৈরী হয়েছিল ‘বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কমিটি’। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য তরুণ আর যুবকদের উদ্বুদ্ধ যেমন করছিল এই কমিটি, তেমনই ব্রিটীশ সরকারের কাছে আবেদনও জানাচ্ছিল যাতে বাঙালীদের নিয়ে সেনাবাহিনীর একটা রেজিমেন্ট তৈরী হয়।
ওই কমিটির মাথায় রাখা হয়েছিল বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মহতাবকে। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী নিজে, ঢাকার নবাব-বাহাদুর সৈয়দ নবাব আলি চৌধুরী, সরলা দেবী আর শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক।
ক্রমাগত দাবী উঠতে থাকায় অনুমতি পাওয়া গেল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার।
অধ্যাপক অশোক নাথ লিখছেন, “১৯১৬ সালের ৭ অগাস্ট বাঙালী সেনাদের নিয়ে দুটি কোম্পানি তৈরীর অনুমতি দেওয়া হল। এটিকে বলা হল ‘বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি’। মাথায় রাখা হল লেফটেন্যান্ট এস জি টেলরকে। এছাড়াও ছয়জন ভারতীয় অফিসার, যাদের ভাইসরয়েজ [গর্ভনর জেনারেল বা বড়লাট] কমিশনড অফিসার এবং ২১৮ জন সদস্য নিয়ে তৈরী হল এই বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি।”
“এর মধ্যে দিয়ে বাঙালীরা দুটো দিকে সফল হল। প্রথমত, ব্রিটীশ সাম্রাজ্যের অন্যান্য দেশ, যেমন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড বা কানাডা যেমন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়েছে, ভারতকেও সেরকমটা দেওয়া হোক, এই দাবী যেমন জোরালো ভাবে পেশ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, বাঙালীরা লড়াকু জাতি নয়, এই তকমাটা মুছে ফেলা যাবে। তরুণ আর যুবকদের মধ্যে উৎসাহ এতটাই তৈরী হয়েছিল যুদ্ধে দেওয়ার জন্য, যাতে অন্যান্য পেশায় তিনগুণ পর্যন্ত বেশী আয় ছেড়ে দিয়েই তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। সেই সময়ে একজন সেপাইয়ের মাসিক বেতন ছিল ১১ টাকা। বেতন কম হওয়ার কারণে পরিবারের যে ক্ষতি হবে, সেটা পুষিয়ে দিতে সমাজের বিশিষ্টজনেরা চাঁদা তুলে যুদ্ধে যাওয়া ওই যুবকদের পরিবারের হাতে তুলে দিতেন,” লিখেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুইডিশ ইতিহাসবিদ অশোক নাথ।
বাংলাপিডিয়া জানাচ্ছে, “এই বাহিনী পরিচিত ছিল ‘বাঙালী পল্টন’ নামে। ১৯১৬ সালের ৩০ অগাস্ট থেকে বাহিনীতে ভর্তি নেওয়া শুরু হয় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। ‘বেঙ্গলি ডবল কোম্পানি’তে ভর্তি হওয়া প্রথম দশজন ১৯১৬-র ১২ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণের জন্য রওনা হন পাঞ্জাব প্রদেশের নওশেরাতে। এরপরে দফায় দফায় সৈনিকদের নওশেরায় পাঠানো হতে থাকে। মাস চারেকের প্রশিক্ষণের পরে ১৯১৭ সালের জানুয়ারীতে দ্বিতীয় দফায় প্রশিক্ষণ নিতে এই ডবল কোম্পানি করাচী যায়।”
ততদিনে বাহিনীতে যোগ দিয়েছে আরও নতুন সদস্য।
ব্রিটিশ সরকার তখন সিদ্ধান্ত নিল ডবল কোম্পানি থেকে এই বাহিনীকে পুরোদস্তুর রেজিমেন্টে উন্নীত করা প্রয়োজন।
সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯১৭ সালের ১ জুলাই করাচীতে আনুষ্ঠানিকভাবে তৈরী হল ৪৯ নম্বর পদাতিক বাহিনী – ফর্টিনাইনথ বেঙ্গলিজ।
কম্যান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পেলেন ১২৬ নম্বর বালুচিস্তান ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্ট থেকে আসা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এ এল ব্যারেট। সেকেন্ড ইন কম্যান্ড হলেন মেজর ভি ভি ভি স্যান্ডিফোর্ড।
বালোচরা চিরকালই যোদ্ধার জাত। সেই তাদের পরিচালনার ভার থেকে সরিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ব্যারেটকে বাঙালী রেজিমেন্টের দায়িত্ব দেওয়ায় তিনি প্রথম থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন।
মি. ব্যারেট যে বাঙালীদের ওপরে কতটা খেপে থাকতেন, সেটা বোঝা যায় ১৯১৭ সালের শেষ দিকের একটা ঘটনা থেকে।
মেসোপটেমিয়ায় বাঙালী পল্টন
এই ‘বাঙালী পল্টন’ মেসেপটেমিয়ার যুদ্ধাঙ্গনে পৌঁছয় ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। তাদের সেখানে যদিও সরাসরি যুদ্ধের কাজে লাগানো হয় নি। তারা মূলত গ্যারিসন ডিউটি করত বা মিলিটারি পুলিশ হিসাবে প্রহরার কাজ করানো হত তাদের। মেসোপটেমিয়ায় পৌঁছনর কয়েক মাস পরে, ডিসেম্বরে, ফর্টিনাইন্থ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মেসোপটেমিয়ায় ব্রিটীশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, জেনারেল স্যার উইলিয়াম মার্শাল।
নিজের স্মৃতিকথা, ‘মেময়ার্স অফ ফোর ফ্রন্টস’-এ জেনারেল মার্শাল লিখছেন, “দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই আমি ওই ইউনিট পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আমাকে স্বাগত জানালেন লেফটেনান্ট কর্ণেল ব্যারেট। পুরো বাহিনীটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন তিনি। ছড়ানো ছিটনো কয়েকটা স্কোয়াড ছিল – কোনওটা ছোট, কোনওটা বড়। প্রথম স্কোয়াডের কাছে পৌঁছতেই লেফটেন্যান্ট ব্যারেট ঘোষণা করেছিলেন, ওটা হচ্ছে ‘মিজলস [হাম রোগ] স্কোয়াড’। দ্বিতীয় স্কোয়াডটাকে পরিচয় করালেন ‘হুপিং কাফ [হুপিং কাশি] স্কোয়াড’ বলে, তৃতীয়টা ছিল ‘স্কারলেট ফিভার স্কোয়াড’। সবগুলো স্কোয়াডের নামই তিনি দিয়েছিলেন নানা পরিচিত রোগের নামে। একজন পরিচিত বাঙালী রাজনীতিবিদের ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি ওই রেজিমেন্টের একজন সিনিয়ার ভারতীয় অফিসার ছিলেন।”
স্কোয়াডগুলিকে নানা রোগের নামে নাম দেওয়ার থেকেই আন্দাজ করা যায় বাঙালী পল্টনের ওপরে কতটা ক্ষোভ ছিল কম্যান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট ব্যারেটের। যদিও, এটা ঘটনা, যে বাঙালী ওই সেনাদের অনেকেই নানা রোগব্যাধিতে ভুগতেন।
মধ্যপ্রাচ্যের জলহাওয়া আর কঠোর জীবন অনেকেরই সহ্য হয় নি। রোগে ভুগে মৃত্যু হত মাঝে মাঝেই।
যেমন ব্রিটেনের ন্যাশানাল আর্কাইভে রাখা ‘ওয়ার ডায়েরি’ নম্বর ডব্লু ও ৯৫/৫০২০/৫ -এ বাগদাদ থেকে পাঠানো একটি বার্তায় ২৭ ডিসেম্বর, ১৯১৭ তে লেখা হয়েছিল, “একজন ভারতীয় সৈন্য সেরিব্রো-স্পাইনাল ম্যানেঞ্জাইটিস রোগে ভুগে বাগদাদের আইসোলেশন হাসপাতালে মারা গেছেন।
ওইরকমই আরেকটি ওয়ার ডায়েরিতে, ১৯১৮ সালের ১০ জুলাই লেখা রয়েছে, “মহামান্য কমান্ডার ইন চীফের আদেশক্রমে নিম্নলিখিত ভারতীয় অফিসারকে তাঁর কমিশন্ড পদ ত্যাগ করা অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ১৯ ডিসেম্বর তারিখ থেকে। অফিসারের নাম, জমাদার কে হাবিবুল্লা (ঢাকার নবাব)।”
তিনি পদ ছেড়ে দেওয়ার আগেই অবশ্য যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা হয়ে যায়।
ঢাকার নবাবই শুধু নয়, বাঙালী পল্টন বা বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের অনেক উচ্চবিত্ত বংশের সন্তানরাই।
ব্রিটীশ দলকে হারিয়ে প্রথম আই এফ এ শিল্ড জেতা কলকাতার মোহনবাগান দলের সচিব ছিলেন যে শৈলেন্দ্রনাথ বসু, তিনি বেঙ্গলি রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিলেন সুবেদার মেজর হিসাবে। তার পরেই বাহিনীতে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন কুমার অধিক্রম মজুমদার, যিনি কলকাতা হাইকোর্টের একজন নামজাদা উকিল ছিলেন।
ঢাকার নবাব ছাড়াও সেখানকার প্রথিতযশা ব্যবসায়ী রণদা প্রসাদ সাহাও যোগ দিয়েছিলেন এই রেজিমেন্টে।
ঘটনাচক্রে, মি. সাহা ও তার ছেলেকে ১৯৭১ সালের ৭ মে পাকিস্তানী বাহিনী অপহরণ করে আরও বহু বুদ্ধিজীবির সঙ্গেই।
হিন্দু-মুসলিম একসাথে থাকতেন
এই বেঙ্গলি রেজিমেন্টই ব্রিটিশ বাহিনীর একমাত্র ইউনিট ছিল, যেখানে ধর্ম, জাতপাত, এসব নির্বিশেষে শুধু বাঙালী বলেই সদস্যদের নেওয়া হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার সমর ইতিহাস বিশেষজ্ঞ অশোক নাথ লিখছেন, “ফর্টিনাইন্থ তৈরী করাই একটা অনন্য পরীক্ষা ছিল। এটাই ছিল প্রথম সম্পূর্ণভাবে বাঙালী রেজিমেন্ট। শিক্ষিত, শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের সন্তানরা এই রেজিমেন্টে যোগ দিয়েছিল। এবং বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ করা হত না, হিন্দু-মুসলমান সকলেই একসঙ্গে থাকতেন। অন্যান্য রেজিমেন্টগুলিতে যেমন মূলত অশিক্ষিত, গ্রামীন কৃষক শ্রেণীর মধ্যে থেকে বাহিনীর সদস্যদের ভর্তি করা হত, তার থেকে এখানেই তফাৎ ছিল বেঙ্গলি রেজিমেন্টের।”
তবে বাহিনীতে যে ‘হিন্দু ভদ্রলোক’দেরই প্রাধান্য ছিল, সেটাও উল্লেখ করছেন মি. নাথ।
তার মতে, বাঙালী মুসলমানরা যদিও এই রেজিমেন্টের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিলেন, তবে তারা ছিলেন সংখ্যায় কম। এর একটা কারণ হল, খিলাফৎ আন্দোলনের প্রভাব। ইসলামের খিলাফৎ এবং অটোমান সাম্রাজ্য রক্ষা করার একটা মানসিকতা ছিল অনেক মুসলমানের মধ্যে। সেজন্যই সম্ভবত তারা বেশী সংখ্যায় এই বাঙালী বাহিনীতে যোগ দেন নি।
আবার যে হিন্দুরা বেঙ্গলি রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন, তাদের মধ্যেও অশান্তি আর গন্ডগোল লেগেই থাকত।
এরকমই একটা অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছিয়েছিল ৯ জুন, ১৯১৮ তারিখে।
ব্রিটীশ লাইব্রেরিতে রাখা ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস বলছে, বসরা শহরের দক্ষিণে সেই সময়ে অবস্থানরত বেঙ্গলি রেজিমেন্টের তিনজন ভারতীয় অফিসার গুলিবিদ্ধ হন।
ওই তিনজন – সুবেদার মেজর শৈলেন্দ্রনাথ বসু, জমাদার আর এল মুখার্জী এবং সুবেদার এ কে মিত্র তাঁদের তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিলেন। পরে মারা যান মি. মিত্র।
একজন নায়েক ও একজন সেপাহীকে গ্রেপ্তার করা হয় গুলি চালানোর জন্য।
কোর্ট অফ এনকোয়ারিতে প্রমাণিত হয় যে ভারতীয় অফিসারেরা তাদের অধীনে থাকা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। সেই রাগেই গুলি চালিয়েছে ওই দুজন। তদন্তকারীরা আরও একজন ভারতীয় অফিসারকে সন্দেহ করেছিলেন গুলি চালনায় যুক্ত থাকার ব্যাপারে, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ধৃতরা দোষ স্বীকার করে নিয়েছিলেন।
তবে গোটা ঘটনাটিকে কিছুটা চেপে যাওয়া হয়েছিল। পত্রপত্রিকাগুলোতেও বিশেষ কিছু ছাপা হয় নি এ ব্যাপারে।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও অবশ্য বেঙ্গলি রেজিমেন্ট আরও বেশ কিছুদিন থেকে গিয়েছিল মেসোপটেমিয়াতেই।
তাদের প্রহরার দায়িত্ব ছিল।
কিন্তু পরের বছর, ১৯৯১ এর মাঝামাঝি কুর্দিস্তানের এক স্থানীয় নেতা, শেখ মাহমুদ আল বার্জিঞ্ঝি তাঁর প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। কাছাকাছি থাকা বেঙ্গলি রেজিমেন্টকে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই একবারই বাঙালী পল্টন সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল।
তবে তারপরে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাম্মিনাহর বিমান ঘাঁটি পাহারা দেওয়ার জন্য।
১৯২০ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত বেঙ্গলি রেজিমেন্ট সেই দায়িত্ব পালন করেছে।
অন্যদিকে যুদ্ধের শেষে বাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা করছে ব্রিটীশ সরকার।
যেসব ইউনিটকে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হচ্ছিল, অথবা যাদের সম্বন্ধে খুব ভাল রিপোর্ট ছিল না, সেইসব রেজিমেন্টগুলোকেই প্রথমে তুলে দেওয়া হতে থাকে।
১৯২০ সালের ১০ অগাস্ট ব্রিটীশ পার্লামেন্টে এ নিয়ে এক প্রশ্ন করা হয়।
লর্ড অ্যাম্পটহিল সরকারের কাছে জানতে চান যে বেঙ্গলি রেজিমেন্ট কী তুলে দেওয়া হয়েছে? ভারত সরকার কী তাদের যুদ্ধকালীন পারদর্শীতায় সন্তুষ্ট?
জবাব দিয়েছিলেন এক বাঙালীই – লর্ড সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিনহা, যিনি পরে ব্যারণ হয়েছিলেন।
“যেভাবে যুদ্ধের সময়ে তৈরী হওয়া অনেক সেনা ইউনিটকে অতিরিক্ত বলে তুলে দেওয়া হচ্ছে, ফর্টিনাইন্থ বেঙ্গলিকে সেইভাবেই তুলে দেওয়া হয়েছে। যদিও একটা অংশকে এখনও টিঁকিয়ে রাখা হচ্ছে। মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধের সময়ে এই রেজিমেন্টের ব্যাপারে ভাল রিপোর্ট আসে নি,” বলেছিলেন লর্ড সিনহা।
নদীয়া, কলকাতা, বগুড়া, যশোর, ঢাকা, খুলনা …
যুদ্ধের বেশ কিছু বছর পরে, কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক উল্টো দিকে কলেজ স্কোয়্যারে গড়ে তোলা হয় একটি শ্বেত পাথরের স্মৃতি সৌধ।
সৌধটির নীচে একদিকে খোদাই করে লেখা আছে, “বেঙ্গলি রেজিমেন্টের সেই সব সদস্যদের স্মৃতিতে, যারা ঈশ্বর, রাজা এবং দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন ১৯১৪ থেকে ১৮র বিশ্বযুদ্ধে”
বাকি তিনটি দিকে খোদাই করা আছে ৪৯ জন সৈনিক ও অফিসারের নাম, কবে মারা গেছেন আর বাংলার কোন জেলা থেকে তারা এসেছিলেন।
এর মধ্যে যেমন আছে বর্ধমান, মেদিনীপুর, ২৪ পরগণা, নদীয়া বা কলকাতা, তেমনই রয়েছে বগুরা, যশোর, ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, ফরিদপুর, পাবনার নাম। রয়েছে ত্রিপুরার নামও।
এই সৌধটি ছাড়াও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরও দুটি স্মৃতি সৌধ রয়েছে। সবথেকে পরিচিতি এবং দৃশ্যমানটি আছে কলকাতা ময়দানে, যেটির নাম ‘গ্লোরিয়াস ডেড সেনোটাফ’ আর অন্যটি যুদ্ধের সময়ে নৌবাহিনীতে কর্মরত যেসব দেশীয় নাবিক বা লস্কর মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের স্মৃতিতে ‘লস্কর মেমোরিয়াল’।
বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির শতবর্ষে রবিবার বাঙালী পল্টন স্মৃতি সৌধ পরিষ্কার করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী, শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা ফুল-মালা দিয়েছেন।
কিন্তু বছরের বেশীরভাগ সময়েই সেটি চূড়ান্ত অবহেলায় পড়ে থাকে। বিশেষ কেউ জানেনও না এই স্মৃতিসৌধটি কিসের বা কী তার তাৎপর্য।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন