রংপুরের পীরগঞ্জে এতিম দুই ভাই-বোনের আহাজারি, সর্বস্ব লুটে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা

প্রায় ১৪ মাস পূর্বে বাবা মনজুর হোসেন দুরারোগ্যে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাবা মারা যাবার শোক কেটে উঠতে না উঠতেই ৩ মাসের মাথায় মমতাময়ী মা মৌসুফা বেগম ৭ বছরের ছোট মেয়ে মাহী আক্তার ও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছেলে নিরব মিয়াকে ফেলে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্রে সংসার পেতেছেন।
বাবা-মাকে হারিয়ে এখন তারা কোথায় যাবে কার কাছেই বা থাকবে, এ ভেবে শুধু সকলের মুখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে। সদাহাস্যজ্বল চঞ্চল স্বভাবের নিরব মিয়ার মুখে আর হাসি নেই। অসহায় অবুঝ ছোট বোন মাহী’র দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নায় কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভেবে রক্তের টানে এতিম দুই ভাই-বোনের দেখভালের দায়িত্ব নেন জ্যাঠা আব্দুর রউফ ও চাচা রন্জু মিয়া। কিন্তু তাদেরও অভাব, টানাটানির সংসার। ৬৫ বছরের বিধবা দাদি মন্জুয়ারা বেওয়া নিজেই হাঁটা-চলা করতে পারেন না।
বাবা-মা হারা নিরব মিয়া নানা প্রতিকুলতার মাঝেও দৃঢ় প্রত্যয়- নিজে লেখা-পড়া করবেন, ছোট বোনকেও করাবেন। বাবা-মা’র রেখে যাওয়া ঘরটিতেই দুই ভাই-বোনের বসবাস। নিরব মিয়া চলতি বছর ভেন্ডাবাড়ী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোটবোন ভেন্ডাবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণির ছাত্রী।
কিন্তু জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে এক খুনের ঘটনায় এতিম দুই ভাই-বোনের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। লেখাপড়া দুরের কথা, দুর্বৃত্তদের ভয়ে এখন অসহায় এতিম দু’ভাইবোন গ্রামছাড়া। তারা নানা নানিসহ মামা, খালা ও ফুপু বাড়িতে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
অথচ তারা ওই খুনের মামলায় আসামি বা অভিযুক্ত না হলেও কেবল মাত্র পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে প্রাণনাশসহ নানা ভয়ভীতি ও হুমকি ধামকি দিয়ে আসছে দুর্বৃত্তরা। অভিভাবকের দায়িত্ব নেয়া জ্যাঠা আব্দুর রউফ ও চাচা রন্জু মিয়া খুনের মামলায় দু’জনেই এখন জেল-হাজতে।
জীর্ণশীর্ণ, চোখ-মুখে অজানা আতংক নিয়ে অসহায় নিরব মিয়া বলেন, গত ৩০ আগষ্ট সকাল থেকে কয়েক দফা ১৫/২০জনের সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তের দল অস্ত্রের মুখে আমাদের (মামলার আসামী পক্ষের) পরিবারের সকলকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ৬টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠে।
ঘরে থাকা নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র (ফ্রিজ, টিভি,খাট, আলমিরা, ড্রেসিং টেবিল), ঘরগুলোর জানালা, দরজা এমনকি টিউবওয়েল পর্যন্ত লুটে নিয়ে গেছে। ওই ৬টি ঘরের মধ্যে আমাদের (দু’ভাইবোন) একটি। নিরব হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, আমাদের একমাত্র অবলম্বন বাবার রেখে যাওয়া ৭০ হাজার টাকা তাও ওরা নিয়ে গেছে।
খাবারের চাউলসহ ব্যারেলটিও রাখেনি। আমাদের বই খাতা, পোষাক কাপড় সবই তারা বাড়ি সংলগ্ন পুকুরে নিক্ষেপ করেছে। আমরা কি অপরাধ করেছি? আমরা এখন নিঃস্ব, অসহায়, কিভাবে বাঁচবো? অবুঝ ছোট বোনটারে মানুষ করবো কেমনে? আমি পরীক্ষা দিবো কেমনে? নানা প্রশ্ন করতে করতে পাশে থাকা ছোটবোন মাহীকে জড়িয়ে ধরে আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিরব মিয়া।
এতিম দুই ভাই-বোনের আহাজারি যেন আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। দুর্বৃত্তকারীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার আশু হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন এতিম নিরব মিয়া।
অমানবিক এ ঘটনাটি ঘটেছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার ভেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামে। ওই গ্রামের জনৈক আবুল কাশেম মিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী আব্দুল জলিল মিয়ার ১ একর ৭৬ শতাংশ জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। গত ২০ আগষ্ট দুপুরে বিরোধপূর্ণ ওই জমির দলখকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ৪ ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়।
আহতদের মধ্যে পাকুড়িয়া গ্রামের আব্দুল জলিল মিয়ার পুত্র গোলাম মোস্তফা (৩৫) রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার (২৪ আগষ্ট) মারা গেলে একই দিনে পীরগঞ্জ থানায় নিহতের ছোট ভাই চান মিয়া বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা নং ৩৮/২০২৫।
এতে ১নং আসামী ভেন্ডাবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান সাদিকুল ইসলাম, সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন মন্ডল, ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আখেরুজ্জামান, ইউপি সদস্য এনামুল হক ও মেজবাহুর রহমানসহ বিভিন্ন এলাকার ৩০ ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ে করা হয়।
এতে ২০/৩০ জন অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে আব্দুল জলিল ও তার লোকজন আসামীদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, হামলা, লুটপাট ও ভাংচুর চালিয়েছে মর্মে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন