রক্তাক্ত ‘৭১- কুমিল্লার মুরাদনগরের গণহত্যা প্রসঙ্গে
কুমিল্লা জেলার সর্ববৃহৎ উপজেলা মুরাদনগর। এটি কুমল্লা জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এ উপজেলার আয়তন ৩৩৯ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পাক বাহিনী প্রথম ক্যাম্প স্থাপন করে। কোম্পানীগঞ্জ সহ গোমতী নদীর দক্ষিণ তীরে সরকারি খাদ্য গোডাউনে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। ব্রিজের উপর মুক্তিযোদ্ধাদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে গোমতী নদীতে লাশ ফেলে দেয়া হতো। এ লাশ ভাসতে ভাসতে চলে যেতো মেঘনা নদীতে। এছাড়া গোমতী নদী দিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টেম্যান্ট থেকে আর্মীরা ছোট ছোট লঞ্চযোগে এসে মুরাদনগরের বিভিন্ন গ্রামে আক্রমন করতো। জলবেষ্টিত মুরাদনগরের অন্যান্য নদী আর্চি, নৈলা, ও বুড়ি যুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনার সাথে জড়িত। গণহত্যা হলো কোনো গোষ্ঠীভুক্ত মানুষজনকে মেরে ফেলা। ইংরেজি প্রতিশব্দ জেনোসাইডের উৎসও একই। এটি গ্রিক জেনোস, অর্থাৎ মানুষ বা বর্ণ থেকে এবং সাইড অর্থাৎ মারা থেকে এসেছে। সেহেতু জেনোসাইডের বা গণহত্যার অর্থ “জাতীয়, নৃগোষ্ঠীয়, বর্ণগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করা কার্য”।
৩১ অক্টোবর চাপিতলা ইউনিয়নের চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে ১টি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। মুরাদনগর সদরে পাক সেনাদের ক্যাম্প ছিল মুরাদনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মুরাদনগরের উল্লেখযোগ্য রাজাকারদের মধ্যে আ: জব্বার (ইউসুফনগর) মরহুম মাজেদুল ইসলাম ভূইয়া, মরহুম মর্তুজ আলী ভূইয়া, মরহুম আব্দুল হালিম (চাপিতলা) অন্যতম। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর পরই মুরাদনগরের জনসাধারণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মুরাদনগরের বিভিন্ন গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। কাশিমপুরের কুদ্দুস কমান্ডারের বাড়িতে বড় ধরণের ক্যাম্প ছিল। চাপিতলা গ্রামে ক্যাম্প ছিল রহমান ডাকাতার বাড়ি, জহিরুদ্দিন ফকির বাড়ি, আলীমুদ্দীনের বাড়ি, ও তছনআলী ভূইয়া বাড়ি।
২০ অক্টোবর চাপিতলা থেকে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে ক্যন্টেমেন্টে হত্যা করা হয়। তাদের কবর সেখানে রয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন শাহজাহান, বিল্লাল হোসেন ও রাজা মিয়া । পাকবাহিনী জানঘরের মুক্তিযোদ্ধা চারু মিয়ার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। চাপিতলায় ২ শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। কামাল্লা বাজারের দক্ষিণের হিন্দু বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। মুরাদনগর সদরের কৃষ্ণনাথের বাড়িতে আগুন লাগায়। কোম্পানীগঞ্জ নিকটে নগরপাড়ের রায় বাড়িতে, রায়তলার গনি সুবেদার বাড়ি, পালাসুতার মতিন কমান্ডারের বাড়িতে পাক সেনারা অগ্নিসংযোগ করে। কোম্পানীগঞ্জের গোমতী নদীর দক্ষিণ পাশে ভিংলাবাড়ি গ্রামে পাক বাহিনীর টর্চার সেল ছিল। এছাড়া চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ গ্রামবাসীকে নির্যাতন করা হতো।
উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ড ঘটে চাপিতলা ও রামচন্দ্রপুরের নিকটবর্তী বাখরাবাদ গ্রামে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রণীত “মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয় ৭ও৮ নভেম্বর চাপিতলার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। কোম্পানীগঞ্জ থেকে ৩ মাইল দূরে চাপিতলা গ্রাম। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কোম্পানীগঞ্জ থেকে নবীনগর যাওয়ার উদ্দেশ্যে ইট বিছিয়ে গাড়ি চলাচলের উপযোগী করে নিচ্ছিল। মুক্তিবাহিনী এ কাজে বাঁধা দেয়ার পরিকল্পনা করে। আর এ পরিকল্পনা করেন ক্যাপ্টেন হায়দার। ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পের অনুমোদন সাপেক্ষে মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হাছান ১ কম্পানী যোদ্ধা নিয়ে তাদেরকে বাঁধা দেয়ার চিন্তা করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক চাপিতলায় ১ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য আরশি নদীর উত্তরে তীরে অবস্থান নেয়। এ সময় পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল চাপিতলা অজিফা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল খামারগ্রাম মাদ্রাসায়। ৭ও৮ নভেম্বর,যুদ্ধ হয়। এত ৪৮ জন গ্রামবাসী ও ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সহ ৫১ জন শহীদ হন। এছাড়া ২১ জন নারী নির্যাতিত হয়, অগ্নিসংযোগ করা হয় ২০৬ টি বাড়িতে।
মুরাদনগরের একটি বিখ্যাত বাজার রামচন্দ্রপুর বাজার। এবাজারে পাক সেনার লুটতরাজ করে। রামচন্দ্রপুর বাজারের পূর্ব পাশে উত্তর ও দক্ষিন বাখরাবাদ গ্রাম। এখানে ২৪ জুলাই কোম্পানীগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প থেকে সেনাবাহিনী গিয়ে লুটতরাজ, হত্যা ও নারী নির্যাতন করে। ১০০টি ঘরে লুটতরাজ করে। নিরীহ গ্রামবাসীদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে। ফিরে আসার সময় তারা ২০ জন যুবককে গাড়িতে করে দেবিদ্ধার নিয়ে আসে। দেবিদ্ধার নিউমার্কেটে এনে তাদেরকে দিয়ে কবর খুড়ে ব্রাশ ফায়ার করে সবাইকে হত্যা করে। তবে ১ টি ছেলে প্রাণে বেঁচে যায়। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর পরই মুরাদনগরের জনসাধারণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা মুরাদনগরের বিভিন্ন গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করে। কাশিমপুরের কুদ্দুস কমান্ডারের বাড়িতে বড় ধরণের ক্যাম্প ছিল। চাপিতলা গ্রামে ক্যাম্প ছিল রহমান ডাকাতার বাড়ি, জহিরুদ্দিন ফকির বাড়ি, আলীমুদ্দীনের বাড়ি, ও তছনআলী ভূইয়া বাড়ি। এছাড়া খামারগাও মাদ্রfসা, দিগলদী গ্রামের দোতলা বাড়িতে , রামচন্দ্রপুর সরকার বাড়িতে, কৃষ্ঞপুর খোকন ভুইয়ার বাড়ি, বৃন্দারামপুর বড়বাড়ি, ফোগরারচর হিন্দু বাড়ি, জাহাপুর জমিদার বাড়ি, চৌহদ্দী ব্যাপারী বাড়ি, কাজিয়াতল প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাহাড়পুর মাদ্রাসা, পাঁচপুকুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, দরানীপাড়া বারেক মাস্টার বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
উপজেলায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ড ঘটে চাপিতলা ও রামচন্দ্রপুরের নিকটবর্তী বাখরাবাদ গ্রামে। তবে তাদেরকে একত্রে কবর দেয়া হয়নি। অধিকাংশ শহীদদেরকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। তবে খামারগ্রামে ৩জন মুক্তিযোদ্ধার কবর একসাথে রয়েছে। এর মধ্যে ২ টি পাকা কবর। এরা হচ্ছেন বলিঘরের আবুল বাশার ও পুস্কুনীরপাড়ের রমিজ উদ্দিন। এছাড়া দরানীপাড়া ৬ জনকে পাশাপশি বাড়িতে দাফন করা হয়েছে। বিশ্বের উল্লেখযোগ্য গণহত্যা-বর্তমান পর্যন্ত বেশ কিছু গণহত্যার ঘটনা দেখা গিয়েছে। ইহুদীদের হত্যার সময়ে জেনোসাইড শব্দ প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, গ্রীক গণহত্যা, আর্মেনীয় গণহত্যা, এশিরিয়ান গণহত্যা, ইউক্রেনীয় গণহত্যা, বাংলাদেশ গণহত্যা, কম্বোডীয় গণহত্যা, গুয়াতেমালান গণহত্যা, কুর্দীয় গণহত্যা, বসনীয় গণহত্যা, রোবণ্ডন গণহত্যা ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনা খবরে এসেছে। এছাড়া মুরাদগরের উত্তরাংশে অবস্থিত “ অদের খাল ”দিয়ে পাশ্বর্বর্তী থানা কসবা থেকে নৌকাযোগে এসে গ্রামবাসীদের উপর অতর্কিত আক্রমন চালাত। তাছাড়া মুরাদনগরের আন্দিকোট ইউনিয়নের গাঙ্গেরকোট গ্রামের রনজিত সাহার বাড়িতে নভেম্বরের প্রথম দিকে পাক বাহিনী ক্যম্প স্থাপন করে। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এখানে অবস্থান করে। আত্মসমর্পনের ব্যাপারটি নিশ্চিত হলে কুটি হয়ে কুমিল্লা সিলেট রোডে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে আক্রমন করে। তখন ২০/২৫ জনের প্লাটুনটির বেশ কয়েকজন মারা যায়। অন্যরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পাক বাহিনী হিন্দু-মুসলমন, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষদের হত্যা করে। তারা জাঙ্গাল গ্রামের অজ্ঞাতনামা এক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। গাঙ্গেরকোট গ্রামের পাক বাহিনীর ক্যাম্পে অবস্থানকারী সেনারা আন্দিকোট ও ইসলামপুর থেকে ধরে আনা লোকদের বুড়ি নদীর তীরে এনে হত্যা করে। তারা সবাই ছিল সাধারণ গ্রামবাসী। শহীদদের মধ্যে মনমোহন দেবনাথ পিতা দারীকা নাথ, মতিলাল দেবনাথ, ও ইন্দ্রজিত সাহার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই এর মতে, গণহত্যা হল সেই হত্যাকাণ্ড যখন কোন একটা ঘটনায় চার বা তার অধিক সংখ্যক মানুষ মারা যায় এবং হত্যাকাণ্ডের মাঝে কোন বিরতি থাকে না। গণহত্যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটে, যেখানে এক বা একাধিক মানুষ অন্যদের মেরে ফেলে।মুরাদনগরের গণহত্যাকৃতদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতি সৌধ স্থাপন করা উচিত।প্রত্যেক শহীদের কবর চিহ্নিত তরে সংরক্ষণকরা উচিত বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন