রাখাইনে তৈরি হচ্ছে ক্যাম্প, বন্দিজীবনের শঙ্কায় রোহিঙ্গারা
সম্পাদিত প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফিরতে পারবে তাদের রাখার জন্য ক্যাম্প তৈরি করছে মিয়ানমার। বাড়িঘরে ফিরতে না দিয়ে ক্যাম্পে একরকম নজরবন্দি রাখা হবে তাদের। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। রাখাইন থেকে নানা মাধ্যমে এমন সব তথ্য পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের মধ্যে দেশে না-ফেরার ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
নাগরিকত্ব দিয়ে প্রত্যাবাসন ও নিজ নিজ বাড়িঘরে ফেরার নিশ্চিয়তা পেলে তবেই রোহিঙ্গারা ভেবে দেখবে মিয়ানমারে ফিরে যাবে কি না।
বৃহস্পতিবার উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ঘুরে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। তারা জানান, দায়সারা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের আওতায় মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার চেয়ে এখানে মরাও ভালো।
এই প্রতিবেদকের কথা হয় কুতুপালং ২ নং ক্যাম্পে আশ্রিত মিয়ানমারের ঢেকিবুনিয়াস্থ ফকিরা বাজারের বাসিন্দা ও সেখানকার (হুক্কাট্টা) চেয়ারম্যান আরিফুল্লাহর (৪৫) সঙ্গে। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য সার্বক্ষণিক প্রচারিত ‘আরভিশন’ চ্যানেলের উদ্ধৃতি দয়ে জানান, গত ২১ নভেম্বর মিয়ানমারের সংসদীয় বৈঠকে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে যে ১৯৪২ সালে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রোহিঙ্গারা ৩ শতাধিক গ্রাম দখল করে সেখানে বসবাস শুরু করে। ওই সব গ্রামে রাখাইনদের পুনর্বাসনে সে মিয়ানমার সরকার কাজ করছে। তাই রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িঘরে ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের রাখার জন্য ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান কুতুপালং লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রাখাইন রাজ্যের হাইচ্চুরাতা মেরুল্লা গ্রামের আরেক (হুক্কাট্টা) চেয়ারম্যান মাস্টার এনায়েত উল্লাহ ( ৪৮)। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন চুক্তির আওতায় যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরতে পারবে তাদের রাখার জন্য মংডুর নলবনিয়া, নয়াপাড়া, নাইছাডং, হাইচ্চুরাতা, মেরুল্লা নাফপুরা, গদুরী এলাকায় ক্যাম্প বানাচ্ছে।’ নাফপুরা এলাকায় ক্যাম্প স্থাপনের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে বলে তিনি খবর পেয়েছেন।
বালুখালী ২ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত মিয়ানমারের বুরা সিকদার পাড়া গ্রামের স্কুলশিক্ষক আব্দুর রহিম (৩৯) জানান, ২০১২ সালে যেসব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হয়েছিল তাদের এখনো রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকায় স্থাপিত ক্যাম্পে বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে। সেখানে ৭ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনাহারে-অর্ধাহারে বিনা চিকিৎসায় মরছে। এবার মিয়ানমার সরকার এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের নামে ক্যাম্পে বন্দি করে রাখার ফন্দি নিয়ে প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
গত ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের প্রতিনিধিদলের নিয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও মিয়ানমার সরকার নানা কৌশলে ওয়ারর্কিং গ্রুপ গঠনে বিলম্ব করছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম ওয়ারর্কিং গ্রুপ গঠনে বিলম্বের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ওয়ারর্কিং গ্রুপ গঠনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ে সরকার আন্তরিক হলেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।
উখিয়ায় বসবাসরত রোহিঙ্গা নেতারা আরো জানান, মিয়ানমার সরকার ঘোষণা করেছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হবে। তবে তাদের আপাতত মংডুর রাখাইন রাজ্যে সীমান্ত এলাকার আশপাশে নির্মিত ক্যাম্পে রাখা হবে। প্রত্যাবাসনের আওতায় পড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার সীমান্ত এলাকায় ক্যাম্প নির্মাণকাজ শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ক্যাম্প নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে।
উখিয়ার থাইংখালী হাকিমপাড়া ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা ক্যাম্প কমিটির সভাপতি আরিফুল হক (৪০) বলেন, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তি সম্পাদন করলেও এখনো রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। পূর্ণ নিরাপত্তাসহ নিজের ভিটায় ফিরতে দেওয়া না হলে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে যেতে অনীহা প্রকাশ করতে পারে।
সীমান্তের শূন্য রেখায় এখনো ৪ হাজার রোহিঙ্গা
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে সীমান্তের তুমব্রু কোনারপাড়া শূন্যরেখায় অবস্থান করা ৬ শতাধিক পরিবারের ৪ হাজার রোহিঙ্গা এখনো সেখানেই অবস্থান করছে। প্রশাসন তাদের ক্যাম্পে ফেরাতে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও তাতে ব্যর্থ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু কোনারপাড়া ঘুরে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২৫ আগস্ট রাতে এসব রোহিঙ্গা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া কেটে জিরো পয়েন্ট দিয়ে প্রবাহিত তুমব্রু খালের পারে ঝুপড়ি বেঁধে আশ্রয় নেয়। পরে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে।
ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, এলাকার পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য এসব রোহিঙ্গাকে ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিতে প্রশাসন বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তারা ক্যাম্পে ফিরতে রাজি নয়।
জাহাঙ্গীর বলেন, স্থানীয় কিছু দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের দেয়া ত্রাণসামগ্রীর ফায়দা লুটার জন্য তাদের ওই স্থান ছেড়ে কোথাও না যাওয়ার ইন্ধন দিচ্ছে।
তবে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিক কলিম উল্লাহ (৩০) জানান, তারা তাদের গ্রামে ও রাখাইনে অবস্থান করা স্বজনদের খোঁজ-খবর নিতে পারছেন বলে সেখানে অবস্থান করছেন।
তুমব্রু গ্রামের গুরা মিয়া, শাহজাহানসহ একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, শূন্য রেখায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা যখন-তখন এপার-ওপার করার কারণে চোরাচালান, মাদক পাচারসহ অনৈতিক কাজকর্ম বেড়েছে। তাদের অবিলম্বে ক্যাম্পে নেয়ার দাবি গ্রামবাসীদের।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন