রাজধানীতে চলাচল করা কোন বাসের মালিক কে?
রাজধানীতে বাস চাপায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিহতের প্রতিবাদে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীতে প্রায়শই বেপরোয়া বাসের চাপায় প্রান হারাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। আবরারের মতো গত বছরের ২৯ জুলাই বাসের জন্য অপেক্কমান অবস্থায় বেপরোয়া বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কে প্রাণ হারায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ শিক্ষার্থী।
এরপরেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে সারা দেশ। আবরার নিহতের ঘটনায় আবারো সেই একই দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে বাতিল করা হয়েছে সুপ্রভাত বাসের রেজিস্ট্রেশন। মঙ্গলবার রাতে আবরারের বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরী বাসের চালক, সহকারীসহ বসের মালিকের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
মঙ্গলবার (১৯ মার্চ) সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর বসুন্ধরা গেট এলাকায় সুপ্রভাত বাসের চাপায় বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হন।
রাজধানীতে বর্তমানে সাড়ে ৪৪ হাজারেরও বেশি গণপরিবহন চলাচল করছে। পাশাপাশি বাড়ছে বিশৃঙ্খলা।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দল ও পরিবহন সংগঠনের নেতারাই এসব বাসের মালিক। এজন্যই পরিবহণ সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না বলে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।
কোন বাসের মালিক কে-
খোঁজ নিয়ে যানা গেছে, সুপ্রভাত সার্ভিসটি আগে পরিচালনা করতেন মোটর পার্টস ব্যবসায়ী মো. আশরাফ উদ্দিন। এক বছর ধরে এ সার্ভিস চলছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।
‘আশরাফ উদ্দিন দায়িত্বে থাকার সময় যাত্রীরা টিকিট কেটে বাস উঠত। ‘আশরাফ উদ্দিন দায়িত্বে থাকার সময় যাত্রীরা টিকিট কেটে বাস উঠত। সব আয় একসঙ্গে জমা হতো। চাঁদাসহ সড়কের সব খরচ মালিক দিতেন। চালক, হেলপার ও সুপারভাইজরদের দেওয়া হতো নির্দিষ্ট বেতন। তাই চালকদের যাত্রী ধরার তাড়া ছিল না। কিন্তু খন্দকার এনায়েত উল্লাহ দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই প্রথা বাতিল করেন। এখন চুক্তির ভিত্তিতে বাস চালাতে হয় চালকদের।
মালিকের দৈনিক জমা চার হাজার, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতিকে চাঁদা দিতে হয় এক হাজার ৩০ টাকা, পাঁচ জায়গায় ওয়েবিল চেক হয়। চেকারদের দিতে হয় ১০ টাকা করে ৫০ টাকা। জ্বালানি লাগে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকার। সার্জেন্ট, পুলিশ ও অন্যান্য খরচ হয় আরো ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এসব খরচ বাদ দেওয়ার পর হেলপার ও সুপারভাইজরকে ২০০ করে ৪০০ টাকা দেওয়ার পর যদি কিছু থাকে তা নেয় চালক।’
তেতুলিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ মাসুম ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী পরিষদের সদস্য। তার বাড়ি ভোলায়। কনক পরিবহন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাই আজিজুর রহমান খানের, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ভাই মমতাজুল ইসলামের বাস চলে ঢাকা-ময়মনসিংহ পথে শামীম এন্টারপ্রাইজ নামে। ঢাকা-গাজীপুর রুটে চলাচলকারী ঢাকা পরিবহন ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটে শৌখিন পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস।
জাবালে নূর পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন মো. জাকির হোসেন। মূলত নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের শ্যালক মো. নান্নু মিয়া ও শাহাদাৎ হোসেনসহ বেশ কয়েকজন ক্ষমতাসীন দলের নেতার বাস রয়েছে এই পরিবহন কোম্পানিতে। মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় নান্নু মিয়া পরিবহন জগতে প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এনা পরিবহনের মালিক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। বিহঙ্গ পরিবহনের মালিক স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মালিক নাসির উদ্দিন খোকন। তেতুলিয়া পরিবহনের চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল ওয়াদুদ মাসুম।
রাইদা পরিবহন লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন, এম এম লাভলী পরিবহন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহিন। ৬ নং মতিঝিল-বনানী ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রহিম। এছাড়া এর সঙ্গে জড়িত আছেন শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা মো. হাসান ওরফে লাল মিয়া।
শিখর পরিবহনের মালিক মাহমুদ হোসেন। এই পরিবহনের সঙ্গে এক সময়ের জাতীয় পার্টির নেতা মাইজু উদ্দিন জড়িত রয়েছেন। এর আগে এই পরিবহন পরিচালনা করতেন দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হওয়া সায়েদাবাদ বাস-মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও যাত্রাবাড়ী-ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রুল আলম মোল্লা। ২০০৯ সালে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম এই পরিবহনটি উদ্বোধন করেন বলে জানা গেছে। এছাড়া শাজাহান খানের পরিবারের মালিকানায় ঢাকা-মাদারীপুরের পথে সার্বিক পরিবহনের বাস চলাচল করে। প্রজাপতি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি শাহিদা তারেখ।
বেস্ট ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের এমডি মাইজু উদ্দিন, লাব্বাইক ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হাসান এবং মঞ্জিল পরিবহন লিমিডেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সোলেমান। ট্রান্সসিলভা (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুকুল মৃধা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার ভাই। এই পরিবহনের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম খোকন। তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থক।
শ্যামলী পরিবহনের মালিক বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ, আকিব পরিবহনের মালিক নাটোর জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. বাসিরুর রহমান খান চৌধুরী এহিয়া, গাজীপুর পরিবহনের মালিক ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দফতর সম্পাদক সামদানী খন্দকার। আনন্দ পরিবহনের মালিক দিদারুল ইসলাম, বন্ধন পরিবহনের মালিক হাজী আইয়ূব আলী, বন্ধু পরিবহনের মালিক মুরাদ হোসেন, গ্রীন লাইন পরিবহনের মালিক হাজী মো. আলাউদ্দিন, ঈগল পরিবহনের মালিক বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান অশোক রঞ্জন।
দ্বীপ বাংলা পরিবহনের মালিক ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যকরী সভাপতি আজমল উদ্দিন আহমেদ সবুর। দি নিউ আনন্দ পরিবহনের মালিক ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মুক্তার হোসেন। গাবতলী-উত্তরা রুটের বসুমিত পরিবহনের মালিক একই সংগঠনের প্রচার সম্পাদক আব্দুল মনসুর বুলবুল। ওই সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বিকল্প সিটিং সুপার ও বিকল্প অটো সার্ভিসের মালিক।
নারায়ণগঞ্জের মদনপুর থেকে গুলিস্তান রুটে পরিচালিত শ্রাবণ ট্রান্সপোর্টের পরিচালক মীর আব্দুস সেলিম। সেলিম এক সময়ের সেভেন স্টার গ্রুপের সদস্য বকুল ওরফে ভাগিনা বকুলের দুলাভাই। আসিয়ান ট্রান্সপোর্টের মালিক আব্দুল বাতেন বাবু সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি। বোরাক পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঈদ্রিস। কোমল মিনিবাস পরিবহনের মালিক মজিবুর রহমান। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী মেজবাউল হোসেনের বোন পারভীন হোসেনের মালিকানাধীন পরিবহন ক্যান্টনমেন্ট পরিবহন।
ইতিহাস ও ঠিকানা পরিবহনের মালিক মো. রিপন। তিনি পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আত্মীয় হিসেবে পরিবহন সেক্টরে নিজেকে পরিচয় দেন। তানজিল পরিবহনের মালিক আমেরিকা প্রবাসী খোকন। এই পরিবহন ছাড়াও বিহঙ্গ, মিডওয়ে, মিডল্যান্ড ও বিকল্প পরিবহনসহ বেশ কিছু কোম্পানিতে তার বাস রয়েছে বলে জানা গেছে।
সোহাগ পরিবহনের মালিক বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফারুক তালুকদার সোহেল। ঢাকা-কুমিল্লা রুটের এশিয়া লাইনের মালিক জুলহাস হোসেন। ঢাকা-রামগঞ্জ রুটের আল বারাকা পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা রফিক আহমেদ।
আকিক পরিবহনের মালিক ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর উত্তরের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল ইসলাম আশিক, স্বাধীন এক্সপ্রেস ও আয়াত পরিবহনের মালিক ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলাম।
গ্লোরী এক্সপ্রেসের মালিক ও চেয়ারম্যান পুলিশের সাবেক আইজি এ কে এম শহীদুল হকের ভাই এ কে এম ইসমাইল হক। সায়েদাবাদ টার্মিনালের আখতার নামের এক ব্যক্তি এই পরিবহনটি দেখাশোনা করেন। গুলিস্তান-নারায়ণগঞ্জ রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবহন জেডএন করপোরেশনের মালিক নারায়ণগঞ্জের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান।
স্বদেশ ও রানীমহল পরিবহনের পরিচালক আব্দুর রহমান। স্বদেশ পরিবহনের মালিকানায় আরও রয়েছেন গোপালগঞ্জের আওয়ীমী লীগ সমর্থক শেখ কবিরের ভাই, জিয়া। তিনি বাহন পরিবহনের সঙ্গেও জড়িত বলে জানা গেছে। এ কে পরিবহনের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন।
দোয়েল পরিবহনের মালিক গুলজার হোসেন, বেকার পরিবহনের মালিক ওমর ফারুক, গ্রীন বাংলা পরিবহনের মালিক মো. নাজিম মীর, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির মালিক শহীদুল ইসলাম। গ্যালাক্সি লাইন ট্রান্সপোর্টের মালিক মিলন। নূর এ মক্কা পরিবহনের ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ খোকন। তিনি জাবালে নূর ও নূর এ মক্কা পরিচালনায়ও রয়েছেন।
এছাড়া অনন্যা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরানুর রশিদ তুহিন, রবরব পরিবহনের পরিচালক সুমন আলী, আলিফ পরিবহনের মালিক সাইদুর রহমান, দিশারী পরিবহনের পরিচালক আজমুল হুদা মাসুদ, এম এ লাভলি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহিন, বিকাশ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহরাব হোসেন, বাধন পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিদারুল ইসলাম, আল মক্কা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল উদ্দিন, গ্যালাক্সি লাইন পরিবহনের পরিচালক মিলন, রাজধানী সুপার সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার মনির আহমেদ, বৈশাখী পরিবহনের মালিক নূর মোহাম্মদ খান, খাজাবাবা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নান্টু, আয়াত পরিবহনের মালিক সাইফুল ইসলাম, অছিল পরিবহনের মালিক কাউছার আহমেদ, পরিস্থান পরিবহনের মালিক শেখ শিরিন শান্তি, ওয়ান লাইন পরিবহনের মালিক ফিরোজ উদ্দিন এবং ভূঁইয়া পরিবহনের মালিক তোফাজ্জল হোসেন মন্টু সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তারা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সমর্থন করেন। এছাড়া তারা পরিবহন রাজনীতি ও পরিবহন ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন