রাজনীতিতে বাড়ছে প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব!


বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ কমছে রাজনীদিবিদদের৷ বাড়ছে প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের প্রভাব৷ এমনটিই মনে করছেন কোনো কোনো রাজনীতি বিশ্লেষক৷


রাজনীতির অঙ্গনে এমন পরিবর্তনকে বিশ্লেষকরা বলছেন, কাঠামোগত পরিবর্তন৷ রাজনীতি বিশ্লেষক আফসান চৌধুরীর মতে, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে দেখা গেছে৷

তিনি বলেন, ‘‘এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বাড়ার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে৷ আর বিএনপি যেহেতু গত ১০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে, তাই আমলাতন্ত্রে তাদের তেমন অবস্থান আর আছে বলে মনে হয়না৷”

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিবিদদের হাতেই ছিল৷ কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই৷ গত ২০-২৫ ধরে রাজনীতিবিদরা নিজেরাই নির্ভরশীল হচ্ছেন আমলাতন্ত্রের ওপরে৷”

এটাকে ঔপনিবেশিক ধারণার প্রভাব বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী৷ ‘‘বাংলাদেশে টিকে থাকার জন্য, ক্ষমতায় থাকার জন্য, রাজনীতিবিদদের জন্য আমলাদের ভূমিকাই বেশি,” বলেন তিনি৷ ‘‘পুরো দক্ষিণ এশিয়ায়ই ঔপনিবেশিক শাসনের এটা একটা ধারাবাহিকতা৷ নতুন কোনো বিপ্লবী রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি৷”

তিনি বলেন, ‘‘আমলারা অনেক ক্ষমতাধর৷ তারা প্রশিক্ষিত৷ শাসনামলের পরিবর্তন হলেও তাদের কোনো পরিবর্তন হয়না৷ আর এটা বেসামরিক ও সামরিক দুই ধরনের আমলাদের জন্যই প্রযোজ্য৷ এক- এগারোর পর ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর কিন্তু জেনারেল মঈন ইউ আহমেদই সেনাপ্রধান ছিলেন৷”

আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একাত্তরের পরে সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন৷ তার সিদ্ধান্ত নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছেনা৷ কিন্তু তার পাশে বসে আছে আমলাতন্ত্র৷”

তিনি যোগ করেন, ‘‘আমাদের রাজনীতি অনেকটা এখন সিলেকশন নির্ভর৷ পছন্দের লোক সিলেকশন করা হয়৷ এখন এই সিলেকশন নির্ভরতা সফল করতে হলে প্রয়োজন পড়ে উন্নয়নের৷ এই উন্নয়নতো আমলাদের হাতে৷ সেখানে রাজনীতিবিদদের কোনো হাত নেই৷ ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ে৷”

আর বিএনপি’র প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘বিএনপি ১০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকায় আমলাতন্ত্রেতো তার লোক নেই৷ তারতো অসনুসারী সৃষ্টি হচ্ছেনা৷ আমলাতন্ত্রের ভেতরে যে তার লোক থাকবে সেটাইতো সম্ভব নয়৷”

তাঁর মতে, ‘‘রাজনৈতিক রাষ্ট্র না, অনেক বেশি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দিকে যাচ্ছি আমরা৷ রাজনীতিতো বাংলাদেশে স্ট্রাকটারড নয়৷ আমলাতন্ত্র ষ্ট্রাকচারড৷ ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে৷”

বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাধারণ হিসেবে বলা হয় যে, ব্যবসায়ীদের প্রভাব বাড়ছে, অথবা সংসদে রাজনীতিবিদদের চেয়ে ব্যবসায়ী বেশি৷ সেটা আসলে সাধারণ হিসেব৷ বিশ্লেষকরা কাঠামোগত প্রবণতার কথা বলছেন৷ তাদের মতে, এই কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে রাজনীতিবিদরা দৃশ্যমান হলেও নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছে আমলাতন্ত্র৷ তারা বলছেন, এবারের নির্বাচনের আগে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক আমলারা আওয়ামী লীগে সবচেয়ে বেশি যোগ দিয়েছেন৷ ঐক্যফ্রন্টেও যোগ দিয়েছেন, তবে কম৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার বলেন, ‘‘১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতক ক্ষমতা রাজনীতির বাইরে নেয়া হয়৷ অন্যদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা তুলে দেয়া হয়৷ তারপর সেই ধারবাহিকতায় সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন হয় সেখানে নতুন আরেকটি বিষয় দেখা যায়৷ রাজনীতিতে নতুন কিছু লোকের আবির্ভাব হয়৷ তারা হলেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বেসামরিক আমলা এবং বড় কিছু ব্যবসায়ী৷ এখন আমাদের দেখা দরকার যাদের আমরা রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা দেখছি তাদের কতজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দক্ষ৷ তাই দক্ষতার এই প্রশ্নে আমরা চাই বা না চাই রাজনৈতিক ক্ষমতা আমলাতন্ত্রের হাতে চলে যাচ্ছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘আর রাজনীতিটা যদি রাজনীতির মধ্যে না থেকে ম্যানুপুলেশনটা প্রধান হয়ে যায় তখন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ আমলাতন্ত্র এখন রাজনৈতিক সার্ভিস দিয়ে তার সুবিধাগুলো নিয়ে নিচ্ছে৷”-ডয়চে ভেলে’র সৌজন্যে।