রাজনীতিতে সুবাতাস…

বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে অসহিষ্ণুতার কালো আবরণ সরতে শুরু করার লক্ষণ দেখছেন বিশ্লেষকরা। কাদা ছুড়াছুরি ও দায়িত্ব জ্ঞাণহীন বক্তব্য, জঘণ্য ভাষায় আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ থেকে বের হয়ে সাবলীল রাজনৈতিক বক্তব্যে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে রাজনীতিকরা। সর্বশেষ তার প্রমাণ মিলেছে আওয়ামী লীগের মহা সমাবেশের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্য নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়কে ঘিরেই রেখেছেন। যা অতীতে দেখা যায়নি।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক কৌশলের জবাব রাজনীর মাধ্যমেই দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেখিয়েছেন চরম রাজনৈতিক উদারতা। বিরোধী দলকে কটাক্ষ না করেও সমালোচনা করেছন।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন রাজনৈতিক দর্শনকে সাদরে গ্রহণ করেছন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। সাধারণ জনগণকেও করেছে আশ্বস্ত। দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকদের কাছে তার এমন রাজনৈতিক উদারতা প্রশংসিত হয়েছে। তাদের মতে, সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগেই রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা প্রয়োজন। যা গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজন।

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন দেশের ৭৭টি ঐতিহাসিক নথি ও প্রামাণ্য দলিলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ভাষণকেও গত মাসের শেষে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করে নেয় ইউনেস্কো। এই ভাষণটি পায় ইতিহাসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৭ মার্চের ভাষণটি ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ইউনেস্কোর কাছে আবেদন করেছিল সরকার। সেই আবেদনে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।

ইউনেস্কোর দেয়া এই স্বীকৃতি উদযাপনে নাগরিক কমিটির ব্যানারে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রধান অতিথি করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। নাগরিক কমিটির ওই আয়োজনের সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। নাগরিক কমিটির ব্যানারে সমাবেশটি হলেও তা রূপ নেয় আওয়ামী লীগের মহা সমাবেশে।

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ থেকেই গাড়িবহর নিয়ে হাজির হয় দলীয় নেতা-কর্মীরা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সমাবেশ হয়ে যায় মহা সমাবেশে। সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের হাতে এখন তেমন কোনো ইস্যু নেই মহা সমাবেশ করার। কিন্তু কয়েক দিন আগে ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে ১২ নভেম্বর প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি এক মহা সমাবেশ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখানেও মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

সেই মহা সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের প্রতি কোনো বিদ্বেষ ছড়ানো বক্তব্য দেননি। বিএনপির উপর যে নির্যাতন করা হয়েছে তাও ক্ষমা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। দীর্ঘ দিন পরে বিএনপি এতোবড় একটি সমাবেশ করতে পেরেছে, তা দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। উজ্জীবিত ককরে তৃণমূল কর্মীদের। মামলা-হামলায় যে দলের নেতাকর্মী শূণ্য হওয়ার কথা, সেই দলের সমাবেশেই আশা জাগানো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

এতোবড় সমাবেশের উত্তর কীভাবে দেবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, তা নিয়েই চলে সরব আলোচনা। রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সরকারি অফিসগুলোতে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয় দুর্গতিতে থাকা বিএনপির ওই সমাবেশ। আলোচনায় চলে আসে ইতিবাচক রাজনীতির কথা। প্রশংসা কুড়ায় খালেদার ব্ক্তব্য।

বিষয়টি আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। নেতাকর্মীরাও খুঁজতে থাকে নতুন কর্মসূচি। যদিও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বিএনপির সমাবেশের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। গুরুত্ব দিতে চায়নি কেন্দ্রও। কিন্তু ইমেজ রক্ষায় পাল্টা কর্মসূচিও প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি দল হওয়ার পরেও রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি তা বুঝাতেই মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। আর তৃণমূলের কর্মীদেরও চাঙা করার প্রয়োজন ছিল। সেই বিবেচনায় এই কর্মসূচির বিকল্প ছিল না।

কিন্তু হাতে কোনো কর্মসূচি ছিল না, অপরদিকে মহাসমাবেশ করলে বিএনপি যদি দাবি করে বসে, সরকার ভয় পেয় মহা সমাবেশ করেছে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে, উত্তর দিতে কিছুটা কৌশলী হয় আওয়ামী লীগ।

নাগরিক কমিটির নামে সমাবেশ করলে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি হিসেবে সমাবেশ করা যাবে, আবার ইউনেস্কোর স্বীকৃতিতে দলীয় তকমাও লাগবে না। শুধু আওয়ামী লীগের নামে করলে বিষয়টা এক কেন্দ্রীক হয়ে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। তাই সিদ্ধান্ত হয়, গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে নাগরিক কমিটির নামে ব্যানার হবে।

কিন্তু সমাবেশকে করা হবে মহা সমাবেশে। যদি মানুষ কিছুটা কমও হয়, তাহলে বলা যাবে, এটা আওয়ামী লীগের দলীয় সভা নয়। এভাবে দলের শক্তিও পরীক্ষা করে নেয়া যাবে বলেই মনে করেন কেন্দ্রীয় নেতারা।

বলা যায় এই কৌশলে আওয়ামী লীগ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সফলতা লাভ করেছে। যদিও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমাবেশের আগের দিন বলেছেন, এটি পাল্টাপাল্টি সমাবেশ নয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দেয়ায় এই সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে।

বিএনপির সেই মহা সমাবেশে খালেদা জিয়াও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার বাজে মন্তব্য করেননি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে কথা বলেছেন তিনি।

দুটি সমাবেশেই বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া যায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় দলগুলোতে পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও আস্থার বেশ সংকট দেখা দিয়ে আসছে। সেই পরিস্থিতিতে দুটি সমাবেশই প্রমাণ করে রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনমুখী।

সংসদের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের শেষ দিকে বা ২০১৯ সালের প্রথম দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকেই দেশ-বিদেশে এই নির্বাচন নিয়েই আলোচনা চলছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘণিয়ে আসছে, ততোই নির্বাচনমুখী হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। গত নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন থাকলেও আগামী নির্বাচন যাতে প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত না হয়, সেজন্য আওয়ামী লীগও চাচ্ছে সুন্দর একটি নির্বাচন হোক।

বিএনপিও চাচ্ছে যেকোনোভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে। এজন্য খুবই সতর্কভাবে কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে দলটি।

রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, দুই দলই রাজনীতি সুলভ আচরণ শুরু করেছে। দলগুলোর কেন্দ্রীয় থেকে শুরু করে মধ্য ও দ্বিতীয় সারির নেতারাও তাদের ব্ক্তব্যে সংযত আচরণ শুরু করেছেন। যা রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য ভাল হবে। যদি নির্বাচনের পরেও এই আচরণ থাকে তা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক হবে।