রাজশাহীর কালাই রুটির শহর!
সন্ধ্যায় ভিড় জমে যায় রাস্তার পাশে সারি সারি দোকানে। একটু দাঁড়ালেই শোনা যাবে, ‘আর একখান দাও গো মামা।’ অথবা ‘জবের ব্যাপার ভাই, চাইলাম তো দিছেন না কেনে?’ পাশে ভাটির মতো চুলার ওপর সেঁকা হচ্ছে কালাইয়ের রুটি। গরম-গরম সে রুটি চলে আসছে থালায়। আর বাটিতে আসছে লাল শুকনো মরিচ দিয়ে কষানো ধোঁয়া ওঠা হাঁসের মাংস। অথবা কাঁচা মরিচ বেটে তাতে নুনের ছিটে আর কাসুন্দি দেওয়া চাটনি কিংবা ঝাল ঝাল বেগুনভর্তা, ওপরে সরিষার তেল দেওয়া।
দেশের আমের শহর, রেশমের শহর কিংবা শিক্ষা নগরী হিসেবে রাজশাহীর খ্যাতি তো আছেই, তবে শীতকালে রাজশাহীর পরিচয় যেন হয়ে ওঠে কালাইর রুটির শহর। কালাইর রুটি, অর্থাৎ মাষকলাইয়ের ডালের গুঁড়ো আর আনুপাতিক হারে চালের গুঁড়ো মিশিয়ে বানানো রুটি। এটি রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানীয় খাবার। কিন্তু এ খাবারটি এখন আর স্থানীয় নেই। সারা দেশের মানুষ এখন কালাই রুটির নাম জানেন।
রাজশাহীর একটি মোড়ের নাম ফাটাকেষ্টর মোড়। লোকে বলে, মিঠুন চক্রবর্তীর সিনেমা ‘ফাটাকেষ্ট’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এ নাম রাখা হয়েছে। তবে দুষ্টু লোকেরা অন্য কথাও বলেন। যা-ই হোক। সেই মোড়ে তেমন কিছু নেই। আছে একটি চায়ের দোকান। আর আছে মিনা বেগম নামে এক নারীর রুটির দোকান। গাছতলায় পলিথিনের ছাউনির নিচে বসে কালাইর রুটি বিক্রি করেন মিনা। মিনার মতো উপশহরের রিপন আলী নিজের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন এই কালাইর রুটি বিক্রি করেই। এই তো বছর পাঁচেক আগেও ছোট্ট একটা দোকানে রিপন কালাইর রুটি বিক্রি করতেন। এখন রাজশাহী উপশহরে তাঁর দুটি রুটির দোকান। নাম ‘কালাই হাউস’। তেরখাদিয়ায় ‘কালাই হাউস অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’ নামের আরও একটি হোটেল করেছেন তিনি। সব কাজ এখন কর্মচারীরাই করেন। রিপন ব্যস্ত থাকেন হিসাবনিকাশ নিয়ে। উপশহরে যখন রিপন একটা দোকান নিয়ে ক্রেতাদের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, তখন তার পাশেই রুটির হোটেল দেন আবদুস সাত্তার। তাঁর হোটেলের নাম ‘কালাই বাড়ি’। তারপরও ক্রেতা কমেনি বলে রিপন পাশে আরও একটি হোটেল দেন।
গত কয়েক বছরে রাজশাহী শহরে এ রকম অনেক কালাইর রুটির হোটেল গড়ে উঠেছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের জন্য আলাদা কালাইর রুটির হোটেলও হয়েছে শহরে। সে রকমই একটি হোটেলের নাম ‘তেরো পার্বণ’।
আধুনিক এই হোটেলটিতে মাটির থালাবাটিতে পরিবেশন করা হয় কালাইর রুটি। আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজের সামনের ফুটপাত কিংবা শহরের পাড়া-মহল্লার অলিতে-গলিতে আছে ছোট ছোট রুটির দোকান। সেগুলো মূলত চালান নারীরা। সেসব দোকানে পাওয়া যাবে একেবারে বাড়ির রুটির স্বাদ।মাষকলাই আর চালের গুঁড়োর মিশ্রণে তৈরি এ রুটি রাজশাহীর চরাঞ্চলের মানুষের খাবার হিসেবে পরিচিত হলেও কালাইর রুটি হালে অভিজাত পল্লির রসনায় হানা দিয়েছে। ফলে রাজশাহীতে তৈরি হয়েছে ‘কালাইর রুটি’র ক্রেজ। প্রথাগত অনুষঙ্গের বাইরে এখন অনেক কিছু দিয়েই খাওয়া হচ্ছে এ রুটি।
হোটেলগুলোয় ৮ থেকে ১০টি চুলোয় কালাইর রুটি তৈরি করে যান পুরুষ কারিগরেরা। তারপরও রুটির জন্য মানুষকে বসে থাকতে হয় কিছুটা সময়। রাজশাহী শহরের বাসিন্দারা তো খানই, বাইরে থেকে কেউ গেলেও কালাইর রুটি খেতে ভুল করেন না। শখ করে তাঁরা রাতের খাবারটা কালাইর রুটি দিয়েই চালিয়ে দেন।
হোটেলগুলোয় দুই ধরনের রুটি পাওয়া যায়। একটা সাধারণ, অন্যটা স্পেশাল। সাধারণ রুটিগুলোর ক্ষেত্রে তিন কেজি চালের গুঁড়োর সঙ্গে এক কেজি মাষকলাইয়ের গুঁড়ো মেশানো হয়। স্পেশাল রুটি আকারে একটু বড়। চাল ও মাষকলাইয়ের গুঁড়ো থাকে সমান সমান। হোটেলগুলোয় স্পেশাল রুটিরই চাহিদা থাকে বেশি। আর রুটির সঙ্গে বেশি বিক্রি হয় হাঁসের মাংস।
প্রায় সারা বছর পাওয়া গেলেও শীতকালে কালাইর রুটির চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। গরম-গরম গরু, হাঁস কিংবা কোয়েল পাখির মাংস ভুনা, বট, কাঁচা মরিচের ভর্তা, ধনেপাতার চাটনি অথবা বেগুনভর্তা দিয়ে খাওয়া হয় কালাইর রুটি। তবে শহরের অলিতে-গলিতে নারীদের ছোট ছোট দোকানে থাকে শুধু কাঁচা মরিচের ঝাল আর বেগুনভর্তা। ছোট ছোট দোকান সারা দিন খোলা থাকে। আর ভালো মানের হোটেলগুলো খোলা থাকে মধ্যরাত অবধি।
রাজশাহীর সব হোটেলেই একটি সাধারণ কালাইর রুটির দাম ২০ টাকা। স্পেশাল রুটির দাম ৩০ টাকা। রুটির সঙ্গে বিনে পয়সায় মেলে কাঁচা মরিচের ভর্তা ও ধনেপাতার চাটনি। বেগুনভর্তার দাম ১০ টাকা। হাঁসের মাংস ১০০ টাকা, হাফ ৬০ টাকা। গরুর মাংস ফুল ১২০ টাকা, হাফ ৭০ টাকা। এক বাটি বটের দাম ৮০ টাকা, হাফ ৫০ টাকা।
ঘুরতে গিয়ে তো শুধু কালাইর রুটি খেলেই চলবে না। দেখতেও হবে। রাজশাহী শহর বেশ পুরোনো। এ শহরেই আছে আমাদের দেশের প্রাচীনতম জাদুঘর-বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম। পাশেই পদ্মা নদী। শীতের পদ্মার রূপ একেবারে ভিন্ন বর্ষার থেকে। আছে দেশের পুরোনো কলেজগুলোর অন্যতম রাজশাহী কলেজ। আর শীতে অবশ্য দর্শণীয় জায়গা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এখন বিশাল ক্যাম্পাসের প্রতিটি ভবনের সামনে দেখতে পাবেন ফুলের বাগান।
আমি নিশ্চিত, দীর্ঘদিন আপনি একসঙ্গে এত ফুল দেখেননি। একটু দূরে পাবেন পুঠিয়ার রাজবাড়ি। সেখানে দেখা যাবে একসঙ্গে অনেক টেরাকোটা শোভিত মন্দির। তার পাশেই বাঘা উপজেলায় দেখা যাবে বিখ্যাত বাঘা মসজিদ।
বিভাগীয় শহর বলে রাজশাহীতে থাকার জায়গার ব্যবস্থা ভালোই। ভালো মানের হোটেল তো আছেই। আছে পর্যটন মোটেলও। সাপ্তাহিক ছুটিতে ঘুরে আসতে পারেন রাজশাহী।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন