রূপগঞ্জের নাওড়ায় মোশা বাহিনীর তাণ্ডব; গুলিতে নিহত-১

রাজধানীর উপকণ্ঠ রূপগঞ্জের নাওড়া গ্রামে গত কয়েক দিন ধরে দফায় দফায় তাণ্ডব চালাচ্ছে শীর্ষ সন্ত্রাসী, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, পুলিশের ওপর হামলাসহ ৫৩ মামলার আসামি মোশাররফ হোসেন মোশা ও তার বাহিনী। এলাকার নিরীহ মানুষের জমি বসতভিটা দখল ও আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে মোশার নেতৃত্বে তার বাহিনীর সন্ত্রাসীরা বৃহস্পতিবার (৬ জুন) সন্ধ্যায়ও ব্যাপক হামলা চালায়। এ সময় তারা গুলিবর্ষণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দ্বীন ইসলাম (২২) নামে এক তরুণ নিহত হন। তিনি নাওড়া গ্রামের মিল্লাত সাউদের ছেলে। এ ঘটনায় ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন অন্তত ১৫ জন। রূপগঞ্জ থানার ওসি দীপঙ্কর চন্দ্র সাহা মোশা বাহিনীর গুলিতে দ্বীন ইসলামের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নাওড়া এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এর আগে মঙ্গলবার রাতেও নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা চালায় মোশা বাহিনী। ওই হামলায় ৫ জন গুলিবিদ্ধসহ ১৫ জন আহত হয়। তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। মোশার তাণ্ডব ও সশস্ত্র মহড়ার কারণে স্থানীয়দের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাওড়ার চিহ্নিত ভূমিদস্যু ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশাররফ হোসেন মোশার (৪৮) নেতৃত্বে তার ভাই সন্ত্রাসী আনোয়ার হোসেন (৪০), আলী আজগর (৫৫), সাখাতুল্লাহ (৪২) ও বদি (৫২), মোশার ছেলে নীরব (২৮) ও স্বাধীন (২৪), মোশার সহযোগী সন্ত্রাসী এমারত (৫৫), ফজুল (৫২), সানি (২২), দুলাল (৪৫), আলাদি (৪২), মুসা (৩৪), রুবেল (৩৫), নিলু (৪৪), ভুট্টো (৪৫), শাহাজাদা (৪২), ইয়াজুল (২৮), আরমান (৩৪), ওয়াসিম (৪২), নাজমুল (৩২), রিফাত (২৪), হানিফ (১৮), মোর্শেদ (৩০), আব্বাস (৩৫), আবুল (৪৮), জয়নাল (৩৫), রুবেল মিয়া (৩২), মাছুম মিয়া (৪৬), দেলোয়ার (৪৭), তাজেল (৩৫), মোক্তার (৫৫) ও উসমান (২৪), পূর্বগ্রামের অনিক (৩৫), চনপাড়ার সোহেল, নিমেরটেকের হবি জামান (৪২)সহ ৫০-৬০ সন্ত্রাসী পিস্তল, শটগান, টেঁটা, বল্লম, জুইতা, রামদা, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল, সামুরাইসহ নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে।

মোশা বাহিনী গ্রামবাসীকে লক্ষ করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গ্রামবাসীও আত্মরক্ষার্থে মোশা বাহিনীর সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মোশা বাহিনীর সঙ্গে গ্রামবাসীর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় মোশা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে দ্বীন ইসলামের মৃত্যু হয়। এ ছাড়াও গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন আরিফ হোসেন, রুবেল মিয়া, আব্দুল্লাহ মিয়া, আল মামুন, সোহেল মিয়া, কামাল হোসেন, লিকন আহমেদসহ আরও অন্তত ১৫ জন। দ্বীন ইসলামের বাবা মিল্লাত সাউদ জানিয়েছেন, মোশা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে তার ছেলে মারা গেছে। তিনি মোশা ও তার বাহিনীর ক্যাডারদের গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।

গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে মোশা বাহিনী হামলায় গুরুতর জখম হন নাওড়া পশ্চিমপাড়ার সাজারুন বেগমের নাতি শাহীনসহ অন্তত ১৫ জন। তাদের মধ্যে ৫ জন গুলিবিদ্ধ হন। সেই হামলার ঘটনায় সাজারুন বেগম বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযোগে সাজারুন বেগম উল্লেখ করেন, মোশারফ হোসেন মোশার নেতৃত্বে তার বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, চাপাতি, দা-ছুরি, চাইনিজ কুড়ালসহ মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রায়ই নাওড়া গ্রামে মহড়া দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে হামলা করে। সাজারুনের অভিযোগ, পূর্বশত্রুতার জের ধরে মোশা বাহিনী দীর্ঘদিন যাবৎ তার পরিবারের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করে আসছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে নাওড়া মধ্যপাড়ার ইউপি মেম্বার জসিম উদ্দিন জসুর বড় ভাইয়ের স্ত্রীর জানাজা ও দাফন শেষে বাদীর নাতি শাহিন (২৯) তার বন্ধু রাজিব (২৪), জাহিদ হাসান (২৬), আমিনুল (৩৫), মো. জাহিদ (২৪), সোহেল (৩০), রুবেল (২৯), হোসেনকে (২২) সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। নাওড়া মধ্যপাড়ায় মোশার ক্লাব ঘরের সামনের রাস্তায় পৌঁছামাত্র মোশার নেতৃত্বে আসামিরা তাদের পথরোধ করে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করতে থাকে। মোশার হুকুমে তার বাহিনীর লোকজন শাহীন ও তার বন্ধুদের বেধড়ক মারপিট করে মারাত্মক জখম করে। প্রাণরক্ষা করতে তারা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় মোশা তার হাতে থাকা শর্টগান দিয়ে শাহীনকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি করে। শাহীনের ডান হাত, ডান কাঁধ, গলা ও ডান কান এবং বুকে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক জখম হয়। মোশার ছেলে নীরবও তার হাতে থাকা শর্টগান দিয়ে গুলি করলে রাজিবের ডান হাত, পিঠ ও বাম পায়ের হাঁটুর নিচে গুলি লেগে মারাত্মক জখম হন। আসামি রিফাত হত্যার উদ্দেশ্যে তার হাতে থাকা শর্টগান দিয়ে গুলি করলে জাহিদ হাসানের বাম কাঁধে গুলি লাগে। আসামি সাখাতুল্লাহ শর্টগান দিয়ে গুলি করলে আমিনুলের ডান পায়ের গোঁড়ালিসহ বিভিন্নস্থানে গুলি লাগে। আসামি ওয়াসিমের শর্টগানের গুলিতে জাহিদ হোসেনের বাম হাতের তালুতে মারাত্মক জখম হয়েছে।

সাজারুন বেগমের অভিযোগে আরও বলা হয়, আসামি রুবেল হত্যার উদ্দেশ্যে তার হাতে থাকা শর্টগান দিয়ে গুলি করলে সোহেলের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের পাশে, বাম হাতের কব্জির ওপরে, ডান হাতের শাহাদাৎ আঙ্গুলের মাঝে, পেটে ও ডান পায়ে গুলি লেগে মারাত্মক জখম হয়েছে। আসামি নাজমুল শর্টগান দিয়ে গুলি করলে রুবেলের গলা ও বুকের ডান এবং বাম পাশে গুলি লেগে যখম হয়। আসামি মুসার শর্টগানের গুলিতে হোসেনের বাম পায়ের হাঁটুর নিচের পিছনের অংশে জখম হয়। আহত শাহীন ও তার বন্ধুদের আর্ত-চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় আসামিরা ফাঁকা গুলি ও ৫ থেকে ৭টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার সময় আসামিরা শাহীন ও তার বন্ধুদের এবং পরিবারের সদস্যদেরও সুযোগ মতো হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলার হুমকি দেয়।

বাদি আরও উল্লেখ করেন, সন্ত্রাসীরা ঘটনাস্থল থেকে চলে যাওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় শাহীন, জাহিদ ও সোহেলকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। অপর ভিক্টিমদের রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসপাতালে ভর্তি করার পর তাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

সাজারুন বেগম বলেন, হামলার পর থেকে আমরা এলাকায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছি। শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশা ও তার দলবল প্রতিনিয়ত এলাকায় মহড়া দেয়। তার বিরুদ্ধে থানায় অর্ধশতের বেশি মামলা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।

গ্রামবাসী জানিয়েছেন, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, মাদক, অস্ত্রসহ ৪৫ মামলার আসামি মোশারফ হোসেন মোশাসহ তার বাহিনীর সদস্যরা আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে নিরীহ গ্রামবাসীর জমি জবরদখল করতে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। মোশা বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। তাদের চোখে ঘুম নেই। জমিদখলে বাঁধা দিলেই শুরু হয় হুমকি-ধামকি। তাতেও কাজ না হলে চলে নৃশংস হামলা। মোশাসহ তার বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ।

রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দীপঙ্কর চন্দ্র সাহা বলেন, সংঘর্ষের সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা চালানো হয়। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।