রোজার ঐতিহ্যগত পটভূমি
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2023/04/Prof.-Abu-Nasar-450x450.jpg)
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2025/02/475351977_1256003665483861_2959209934144112011_n.jpg)
রমজান/রামাদান শব্দের উৎপত্তি আরবী রমস/রামদ ধাতু থেকে। রমস/রামদ এর আভিধানিক অর্থ হলো দহন, জ্বালানো, পোঁড়ানো। মূলশব্দ হল ‘রামায’। অর্থাৎ জ্বলে পুঁড়ে খাক হয়ে যাওয়া বা পুঁড়িয়ে ভস্ম করে দেয়া। রোজা ফারসি শব্দ। আরবীতে বলে সাওম। অর্থাৎ আত্মসংযম সংযত রাখা ও বিরত থাকা প্রভৃতি। ব্যবহারিক অর্থে ও ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদতের নিয়তে সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নামাই রোজা বা সাওম।
রোজা রাখার উদ্দেশ্য- না খেয়ে শরীরকে দূর্বল করে অকর্মন্য করা নয় বরং শরীরকে সামান্য কষ্ট দিয়ে অভ্যাসের কিছু পরিবর্তন ও বিরুদ্ধচারণ করে কাম, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি রিপুকে বশ করে নফস্কে শায়েস্তা করা। তাই রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। রোজা পালন সর্ব যুগেই প্রচলিত ছিল। রোজা শুধু নবী করিম (সঃ) এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববতী নবী রাসুলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিলো। হযরত আদম (আঃ) থেকে হযরত নূহ (আঃ) পর্যন্ত চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ পর্যন্ত রোজা ফরজ ছিল। যাকে ‘‘আইয়ামে বিজ’’ বা ‘উজ্জ্বল দিবস’ বলা হয়।
উল্লেখ্য যে, নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার কারণে হযরত আদম (আ.) এর দেহের রং কালো হয়ে যায়। ফেরেশতাগণ তাঁর দেহের রং আগের মতো পরিবর্তনের জন্য মহান আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ:) এর কাছে ঐশীবাণী পাঠালেন- ‘তুমি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা রাখো’। হযরত আদম (আ:) এ ৩টি রোজা রাখায় তার দেহের রঙ আবার উজ্জল হলো। এজন্য এ ৩দিনকে আইয়ামে বিজ বলা হয়ে থাকে। বেহেশতে যখন হযরত আদম (আ:) নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করেছিলেন এবং তওবা করেছিলেন তখন ৩০দিন পর্যন্ত তার তওবা কবুল হয়নি। ৩০দিন পর তার তওয়া কবুল হয়। এরপর তার সন্তানদের উপর ৩০টি রোজা ফরজ করে দেয়া হয়।
আগের সব শরীয়তে রোজাকে ফরজ করা হয়েছিলো। হযরত নূহ (আ:), হযরত দাউদ (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:) এর আমলেও রোজার প্রচলন ছিলো। হযরত নুহ (আ:) এর যুগে প্রতি মাসে ৩টি রোজা পালনের বিধান ছিলো। মুসলিম মিল্লাতের পিতা সহিফাপ্রাপ্ত নবী হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর যুগেও সিয়াম পালন করা হয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালার কাছে হযরত দাউদ (আ:) এর রোজা ছিলো উত্তম। তিঁনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন। হয়রত মূসা (আঃ) তুর পাহাড়ে আল্লাহর কাছে তাওরাত প্রাপ্তির আগে ৪০ দিন পানাহার ত্যাগ করেছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ) তার ধর্ম প্রচার শুরুতে ও ইঞ্জিল প্রাপ্তির আগে জঙ্গলে ৪০দিন সিয়াম সাধনা করেছিলেন। ইঞ্জিল শরীফে দার বাদশার সময়ে বায়তুল ইলের বাসিন্দা ও বনি ইয়াহুদাদের প্রতি রোজা রাখার উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইতিহাসে পাওয়া যায় চীন, জাপান, কোরিয়া, মিসর ও গ্রীস প্রভৃতি দেশে রোজার প্রচলন ছিল। ইহুদি ও খৃষ্টানদের জন্য রোজা পালনের নিয়ম ছিল। খৃষ্টানরা মুসলমানদের মতো রোজা ফরজ হিসাবে পালন করতো। বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার সন্ধান পাওয়া যায়। বেদের অনুসারী হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাসেরও নিয়ম আছে। সুতরাং জাতি ধর্ম নির্বিশিষে সবার মধ্যে রোজা পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। নিয়ম-কানুন, ধারণা-প্রক্রিয়া ও সময়ের ভিন্নতা থাকলেও মানব জাতির আত্মশুদ্ধির জন্য আদিম যুগ থেকেই অনেক গোত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রোজা প্রচলিত ছিল।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে তিন দিন রোজা রাখার বিধান ছিল। পরে দ্বিতীয় হিজরী সনে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর মাহে রমজান ফরজ হয়। মুসলমানদের রোজার জন্য পবিত্র রমজান মাসই নির্ধারিত। রমজান মাস নারী-পুরুষদের আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ দেয় এবং নৈতিক মূল্যবোধকে শীর্ষস্থানে পৌছিয়ে দেয়। সংযমের মাধ্যমে রোজা নর-নারীদের নৈতিকতা, আদর্শ, স”ছতা ও নিষ্ঠা আনায়ন করে। মানুষের আত্মার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, মিথ্যার উপর সত্য প্রতিষ্ঠা করে, পশুত্বকে অতিক্রম করে মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করে।
রমজানে রোজ রাখার প্রতিদান সকল প্রতিদানের উর্ধ্বে। আল্লাহ তা’আলা এই ইবাদতকে তার নিজের জন্য নিজস্ব এবং একান্ত করে রেখেছেন। তাই তিনি রোজাদারদের রোজার প্রতিদান নিজেই দিবেন। একবার আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা (সাঃ) কে ডেকে বলেলন, আমি উম্মতে মোহাম্মীদের দু’টি নূর দান করেছি যেন দু’টি অন্ধকার তাদের জন্য পরিস্কার হয় অর্থাৎ দু’টি অন্ধকার যেন ক্ষতিকর না হয়। দু’টি নূর হল (১) নূরুল রামাদান, (২) নূরুল কোরআন। অন্ধকার দু’টি হ’ল (১) কবরের অন্ধকার ও (২) কেয়ামতের অন্ধকার। নূরুল রামাদান রোজাদারের দিনে পানাহার থেকে বিরত রাখা এবং নূরুল কোরআন রাতে নিদ্রাগমন থেকে বিরত রাখার সুপারিশ করবে। পবিত্র কোরআনই মানব জাতির একমাত্র নির্ভুল পথ-নির্দেশিকা। মহান আল্লাহ তায়ালা মুক্তি নির্দেশনাস্বরূপ মানবজাতির ও মানব কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক পবিত্র আল-কোরআন এই রমজান মাসেই নাজিল করেছেন। পাক কোরআনের বদৌলতে এই মাসটির ফজিলত অনেকগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাহে রমজানে রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা হলো হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। মুত্তাকির বৈশিষ্ট অর্জনের জন্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষনা করেন যে ‘হে ইমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা মুত্তাকি বা খোদাভীরু হতে পারো’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৩)। রমজান মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। রোজায় তাকওয়া বা আল্লাহভীতি নিশ্চিত হয় এবং অত্যন্ত গভীর ভাবে ধর্মীয় অনুশাসন স্বারিত হয়। এতে আখেরাতের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত হয়।
রোজা বাস্তবিকই আর্তিক নিয়মানুবর্তিতার একটি উপায়। যা মানুষকে নৈতিক শৃক্সখলার ক্ষেত্রে প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষন দেয়।
এমনিভাবে মাহে রমজানের মূল্যবোধ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, সংযম, সহশীলতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। তাই রোজা এক মাসের কিন্তু শিক্ষা বার মাসের। রমজান মাসে রোজাদারদের মধ্যে যে মানবিক মূল্যবোধ, আর্তিক নৈতিক, আদর্শিক ও চারিত্রিক গুনাবলী বিকশিত হয়, তা যদি সারা বৎসর অব্যাহত থাকে, তাহলে এ সমাজ শান্তির সমাজে পরিণত হতে পারে।
রমজান মুসলিম জাতির জন্য বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ মাস। রোজা এক মাসের কিন্তু শিক্ষা বারো মাসের। রমজান রহমতের ফল্গুধারা। রোজা ইবাদতের দরজা। রোজা শরীরের যাকাত। রমজান ইবাদতের বসন্তকাল। রমজানকে মহান আল্লাহ-তা’আলা বিস্ময়কর এবং অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল করেছেন। মানবজাতির আত্মিক উন্নতি, কল্যাণ এবং আত্মশুদ্ধি ও আতœসংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা যুগে যুগে রমজান মাসেই আসামানি গ্রন্থ নাজিল করেছেন। যেমন- হযরত মুসা (আঃ) উপর তাওরাত ৬ রমজান, হযরত ঈসা (আঃ) উপর ইনজিল ১৩/১৮ রমজান, হযরত দাউদ (আঃ) উপর যবুর ১২ রমজান ও হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) উপর মহাগ্রš’ আল-কোরআন রমজান মাসের কদরের রাতে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো- নিজের কাছে সৎ ও বিশ্ব¯’ থাকা। এতে সহায়ক হলো ইহসান বা আল্লাহ’র অস্তিত্বের উপস্থিতির অনুভূতি। এটাই রমজানের শিক্ষা।
![](https://ournewsbd.net/wp-content/uploads/2024/12/469719549_122234398946008134_2936380767280646127_n.jpg)
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন