রোহিঙ্গা ইস্যু : চীন ও রাশিয়ার অবস্থান ক্রমেই নমনীয় হচ্ছে
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান ক্রমেই নমনীয় হয়ে আসছে। আজ বৃহস্পতিবার পরিষদের উন্মুক্ত বৈঠক আহ্বানের বিষয়ে চীন ও রাশিয়ার সম্মতি থেকে এই নমনীয়তার প্রমাণ মেলে বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অনুরোধে নিরাপত্তা পরিষদ ১৩ সেপ্টেম্বর জরুরি ভিত্তিতে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়। চীন বা রাশিয়া তখনো ওই বৈঠকের ব্যাপারে আপত্তি করেনি। বৈঠক শেষে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের সম্মতির ভিত্তিতে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে রাখাইন প্রদেশে ‘অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের’ আহ্বান জানানো হয়। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা প্রশ্নে গত নয় বছরে নিরাপত্তা পরিষদের এটি ছিল প্রথম বিবৃতি।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ মনে করেন, চীন ও রাশিয়ার সম্মতি ছাড়া এই বিবৃতি প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সময়ের বিচারে বলা যায়, চীন ও রাশিয়া এই দুই রাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে।’
একে যদি পরিবর্তন বলা যায়, তাহলে তা সম্ভব হয়েছে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার কারণে। প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে, এই অভাবিত মানবিক বিপর্যয় উপেক্ষা করাও এদের পক্ষে সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, বিশেষত মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনার যেইদ রাদ আল হুসেইন ও উদ্বাস্তু-বিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান ফিলিপ্পে গ্র্যান্ডি অত্যন্ত কঠোর ভাষায় রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার সমালোচনা করেছেন। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনের সাধারণ বিতর্কে আনুষ্ঠানিক ভাষণে একাধিক দেশের নেতারা মিয়ানমারের সামরিক হামলার ফলে যে মানবিক বিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়েছে, তার কঠোর নিন্দা করেছেন।
গত বৈঠকেও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরাষ্ট্রসমূহ সহিংসতার নিন্দা করে। সে বৈঠক শেষে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ম্যাথু রাইক্রফট সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, সহিংসতা বন্ধের ব্যাপারে পরিষদের সব সদস্যই একমত পোষণ করে। তারা মনে করে, রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, আইন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানোর মতো ‘নিরাপদ বিবৃতি’ প্রদান করলেও চীনসহ অধিকাংশ বৃহৎ শক্তি মিয়ানমার সরকারের ওপর সরাসরি কোনো চাপ প্রয়োগে নারাজ। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের মধ্যে তাগিদ নেই। তা ছাড়া মিয়ানমার সরকার অথবা তার সেনাবাহিনীর ওপর কোনো রকম নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারে কোনো পক্ষেরই কোনো আগ্রহ নেই।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ স্বীকার করেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি এখনো আলোচনায় আসেনি। চীন বা রাশিয়া বরাবরই কোনো সদস্যরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপে অনাগ্রহী। তা ছাড়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও তাতে ফল পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এটি একটি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কিন্তু রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের অনন্তকাল অপেক্ষা করার মতো সময় নেই। রাষ্ট্রদূত মাসুদ মনে করেন, আলোচনার ভিত্তিতে যদি রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা যায়, বাংলাদেশের জন্য সেটি হবে সবচেয়ে উত্তম। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ভূমিকা থেকে স্পষ্ট, শুধু কঠোর বিবৃতি দিলে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই। তবে নিরাপত্তা পরিষদ যদি সম্মিলিতভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করে, তা উপেক্ষা করাও তার পক্ষে সম্ভব হবে না। পরিষদ রোহিঙ্গা প্রশ্নে ঠিক কী পদক্ষেপ নেয়, আজকের বৈঠকে তার ইঙ্গিত মিলবে। সদস্যদেশগুলো যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে, সে কথার প্রমাণ হিসেবে গত মঙ্গলবার পরিষদের সদস্যরা এই প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় করে। পরিষদের মঙ্গলবারের কার্যবিধিতে রোহিঙ্গা প্রশ্নটি অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের প্রস্তাব অনুসারে ‘অন্যান্য প্রশ্নের’ অধীনে এই প্রশ্নে মতবিনিময় ঘটে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবারের বৈঠকে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস পরিষদের সদস্যদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতির বিষয়ে বক্তব্য দেন। সংকট সমাধানে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সে বিষয়ে তিনি নিজের প্রস্তাব রাখতে পারেন বলে জাতিসংঘ সূত্রে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘ সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য মহাসচিব নিজে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরে আসতে পারেন। তবে এ ব্যাপারে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সম্মতির প্রয়োজন পড়বে। মহাসচিব শুধু যাওয়ার জন্য যেতে চান না, তিনি চান এই প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন