রোহিঙ্গা নারীরা কাঁদলেন, কাঁদালেন
কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বার্মাপাড়া রোহিঙ্গা শিবির। গতকাল সোমবার, বেলা তিনটার কিছু বেশি। শিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কার্যালয়ের ভেতর থেকে ভেসে আসছে কান্নার শব্দ। কোনো পুরুষকে কার্যালয়ের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কয়েক শ মানুষ আশপাশে জড়ো হয়েছে, জটলা পাকিয়ে আছে।
গণহত্যা, গণধর্ষণ ও শিশুহত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন রোহিঙ্গা নারীরা। শব্দ তাঁদেরই। রোহিঙ্গা নারীদের মুখে নিষ্ঠুরতার বর্ণনা শুনে কেঁদেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তিন নারী—মারেইড ম্যাগুয়ার, শিরিন এবাদি ও তাওয়াক্কল কারমান। রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে সরাসরি ঘটনা জানার জন্যই তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন।
১৯৭৬ সালে নোবেল বিজয়ী ম্যারেইড ম্যাগুয়ার একাধিকবার বললেন, মিয়ানমারে পরিষ্কার গণহত্যা হয়েছে। ২০০৪ সালে নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদি বলেছেন, মিয়ানমার সরকার নিজের মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, আন্তর্জাতিক আদালতে এর বিচার হতেই হবে। আর ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ইয়েমেনের সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মী তাওয়াক্কল কারমান বলেছেন, সু চি যদি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে না পারেন, তবে তাঁর উচিত হবে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো।
এই তিন নারী আরও বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে, তার তুলনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাড়া অপ্রতুল। তাঁরা কয়েকটি মুসলিম দেশের ভূমিকারও তীব্র সমালোচনা করেন।
দেড় ঘণ্টার মতো সময় পার হওয়ার পর ভেজা চোখে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন দলের প্রবীণতম সদস্য উত্তর আয়ারল্যান্ডের মারেইড ম্যাগুয়ার। অশ্রুসিক্ত ও বেদনাহত কণ্ঠে তিনি বললেন, সাতজন নারী তাঁদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। কেউ মিয়ানমার সেনাদের হাতে স্বামীকে হত্যা, কেউবা ভাই হত্যার, কেউ কেউ গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। একজন মা তাঁর ছয় মাসের শিশু হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক আদালতে এই গণহত্যার অবশ্যই বিচার হতে হবে—এমন মত দেন তিনি।
রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখতে আসা নোবেল পুরস্কার বিজয়ীরা বলেছেন, মিয়ানমার সরকারের মদদে সে দেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে এর বিচার না হলে পৃথিবীতে এ ধরনের গণহত্যার ঘটনা আরও ঘটবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অবশ্যই এর বিচার হতে হবে।
গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কক্সবাজারের সরকারি শরণার্থীবিষয়ক দপ্তরে বৈঠকে ও উখিয়া উপজেলার একাধিক শিবিরে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলার পর বিভিন্ন পর্যায়ে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় তাঁরা এসব কথা বলেন।
সকালে দলটি প্রথমে যায় সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ আবুল কালাম রোহিঙ্গাদের আবাসন, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পয়োব্যবস্থা—এসব ক্ষেত্রে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা কী করেছে, তার বিবরণ তুলে ধরেন। তিনজন নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে মহানুভবতার জন্য ধন্যবাদ জানান। শিরিন এবাদি বলেন, মিয়ানমার সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশের কাছ থেকে তথ্য ও দালিলিক সহায়তার প্রয়োজন হবে।
ওই দপ্তর থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের প্রথমে প্রতিক্রিয়া জানান তাওয়াক্কল কারমান। তিনি বলেন, ‘আমরা ঘটনাটিকে গণহত্যা হিসেবেই দেখছি। দুঃখজনকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখানে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার। এই হত্যার ব্যাপারে নীরব থাকা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও লজ্জার।’ তিনি বলেন, নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভ এ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেবে।
শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নারীদের একটি উদ্যোগ নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভ। তিনজনই এর সদস্য। মিয়ানমারের অং সান সু চিও এ উদ্যোগের সদস্য।
দুপুরে এই তিনজন যান থাইংখালী তানজিমারখোলা রোহিঙ্গা শিবিরে। স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় শিরিন এবাদি বলেন, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। অথচ কয়েকটি মুসলিম দেশ কিছুই করছে না। তিনি বলেন, ‘ইরান কোথায়? সৌদি আরব কোথায়? কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত কোথায়?’ তিনি আরও বলেন, এসব দেশ অস্ত্র কিনে মুসলমানদেরই হত্যা করছে।
এরপর তাঁরা যান বার্মাপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে। এই শিবিরে নির্যাতনের শিকার নারীদের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা আগেই করে রাখা হয়েছিল। এখানে নোবেল বিজয়ীদের কাছে এক নারী কীভাবে তাঁর ছয় মাসের শিশুকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নদীতে ছুড়ে ফেলে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়, সেই নিষ্ঠুর বর্ণনা দেন।
এই তিনজন আজ মঙ্গলবারও রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন