রোহিঙ্গা স্রোত : রাখাইন থেকে বাংলাদেশ
চলতি বছর আগস্টের শেষদিকে বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আবারও হত্যা, নির্যাতন শুরু করে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা রাখাইন প্রদেশে। আর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে রোহিঙ্গারা।
অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজার ও বান্দরবানের একাধিক এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নাফ নদে প্রাণহানিও হয় অনেক নারী ও শিশুর। ওই দুর্দশায় রোহিঙ্গাদের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ সরকার। কক্সবাজারের উখিয়ায় কুতুপালং ও বালুখালীতে করা হয় আশ্রয়কেন্দ্র।
জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর জানিয়েছে, গত আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিকের সংখ্যা ছয় লাখ ৩৯ হাজার ৩২০ জন। নিবন্ধনের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে ওই তথ্য।
গত মাসে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন, গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে সই করেছে। তবে প্রতিদিনই রোহিঙ্গা আসছে সীমান্ত পথে। ফেরত যায়নি একজনও। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার বিচারে বিশ্বে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে মুসলিম বিশ্বসহ বিশ্বের অনেক দেশই।
২৫ আগস্ট থেকে শুরু
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরু হয়। ওই অভিযানে নির্বিচারে খুন করা হয় রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষদের। সেনা ও দোসরদের ধর্ষণের শিকার হয় বিভিন্ন বয়সী নারী। লোমহর্ষক এ নির্যাতনের শিকার হয়ে এখনো বাংলাদেশে ছুটে আসছে রোহিঙ্গারা। আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও মানবিক সাহায্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) মতে, বাংলাদেশে এখন ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। তাদের মতে, রোহিঙ্গা আশ্রিত কক্সবাজার এলাকার মানবিক সংকট এখন কল্পনাতীত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
আইআরসি বলছে, তাঁদের অংশীদার প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন কনট্রে লা ফেইমের (এসিএফ) নেতৃত্বে সমপ্রতি মানবিক সংস্থাগুলো কক্সবাজার জেলায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ওপর জরিপ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ ওই জনগোষ্ঠীর পুষ্টি নিয়েই মূলত জরিপটি হয়। জরিপে রোহিঙ্গা শিশুদের অপুষ্টির মাত্রা চরমে থাকা এবং তাদের অপুষ্টি যে সার্বিকভাবে জনস্বাস্থের জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই তথ্য ওঠে এসেছে। রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নিজ মাতৃভূমিতে নিরাপদে ফেরত পাঠানোর দাবি জানিয়ে আসছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা তুলে ধরছে।
এতিম রোহিঙ্গা শিশু সাড়ে প্রায় ৩৬ হাজার
উখিয়া-টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে ‘রোহিঙ্গা এতিম শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে’ জরিপের প্রাথমিক কাজ শেষ করেছে সমাজ সেবা অধিদপ্তর। জরিপে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৩৬ হাজার ৩৭৩ জন এতিম শিশু শনাক্ত করা হয়েছে। এটি জরিপের প্রথম ধাপ। রোহিঙ্গাদের আগমণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে এতিম শিশুদের সংখ্যা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর
মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গত ২৪ অক্টোবর মিয়ানমারে যান। সফরে তিনি বাংলাদেশের নয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। সফরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অং সান সু চিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না, এমন কথা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কখনোই বলেনি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে তাদের ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করার পরই তাদের নিজ ভূমি রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে।
সু চির সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি তাকে বলেছি- আমাদের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। আপনিও দীর্ঘ সংগ্রাম করে আপনার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোকে কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হতে পারে তা তাঁকে অবহিত করেছি।’
নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে
গত ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আট লাখ ৪৭১ রোহিঙ্গা নাগরিকের বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা হয়েছে। পালিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২ অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের এই নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের আওতায় নিয়ে আসতে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুদের নিবন্ধন কার্যক্রম হাতে নেয় বাংলাদেশ সরকার। এই ১২টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমার নাগরিকদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় সাতটি ক্যাম্পের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন কাজ বাস্তবায়নের কাজ করছে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) প্রতিবেদন অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিকের সংখ্যা ছয় লাখ ৩৯ হাজার ৩২০ জন । অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় এ সংখ্যা বাড়ছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭-এর আগে আগত মিয়ানমার নাগরিকের সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৬০ জন। সব মিলিয়ে আট লাখ ৪৭১ রোহিঙ্গা নাগরিককে নিবন্ধনের আওতায় আনা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের দুঃখের কথা শুনে কাঁদলেন প্রধানমন্ত্রী
উখিয়ার কুতুপালংয়ে আশ্রয়ে নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গাদের দুঃখের কথা শুনে তিনি কেঁদেছেন। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ভালো প্রতিবেশী চায়, তবে যদি কেউ অন্যায় আচরণ করে তা কখনো মেনে নেওয়া হবে না।’ তিনি রোহিঙ্গাদের করুণ দৃশ্য দেখে ও তাদের মুখে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে কেঁদেছেন।
এ ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের ৭২তম সাধারণ অধিবেশনে ওই পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা সকলেই জানেন যে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে।’ প্রধানমন্ত্রী জানান, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে ।
খালেদা জিয়ার ত্রাণ বিতরণ
রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে এবং তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করতে গত ৩০ অক্টোবর কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের ময়নারঘোনা এলাকায় যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বিএনপির ত্রাণ কমিটির প্রধান মির্জা আব্বাস আগেই ১১০ টন ত্রাণবাহী ৪৫টি ট্রাক সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। এর মধ্য থেকে কিছু সামগ্রী নিয়ে খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে এর উদ্বোধন করেন। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সবার মধ্যে এই ত্রাণ বিতরণ করেন। এসব ত্রাণের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি শিশুখাদ্য ও মাতৃস্বাস্থ্যের উপযোগী খাদ্যও রয়েছে।
ভাসানচরই হচ্ছে স্থায়ী ঠিকানা
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হবে বলে জানিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার জন্য হাতিয়ার ভাসানচরে উপযুক্ত জায়গা রয়েছে। তাদের সেখানে পুনর্বাসন করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার।
এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসন করা হবে। ভাসানচরকে মানুষ জালিয়ারচর ও ঠ্যাঙ্গারচর নামেও চেনে। ভাসানচর নামটি সুন্দর। সেখানে ভাসমান মানুষেরা থাকবে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন