লাখো মায়ের জীবন রক্ষায় সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রযুক্তি


সারা বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটছে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। এর ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ। সে হিসাবে প্রতিবছর ১৩ লাখ মায়ের মৃত্যু ঘটে প্রসবকালীন রক্তক্ষরণে। আরও ২৬ লাখ নারী মাতৃত্বের সক্ষমতা হারান। এর বড় অংশই ঘটে গরিব দেশগুলোতে।
এই চিরাচরিত চিত্রটি এবার বদলে দিতে ভূমিকা রাখছে খুব সাধারণ আর স্বল্প খরচের একটি প্রযুক্তি। সায়েবাস মেথড (সায়েবা পদ্ধতি) নামের এই পদ্ধতি অজস্র নারীর জীবন বাঁচানোর এক মোক্ষম উপায় হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। যার নামে এই পদ্ধতির নাম রাখা হয়েছে, যিনি এর উদ্ভাবক, তিনি বাংলাদেশের এক চিকিৎসক অধ্যাপক সায়েবা আক্তার। ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টসের পক্ষ থেকে তাঁকে এই উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয়।
একটি ক্যাথেটার, একটি সাধারণ কনডম আর স্যালাইন পানি—এই তিনটি মামুলি ও সহজলভ্য উপকরণ ব্যবহার করে সায়েবা আক্তার যে ‘কিট’ বানিয়েছেন, সেটি ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রসূতি মায়ের জীবন রক্ষা করতে সফল হয়েছে। বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশ ও দক্ষিণ আমেরিকার এক ডজন দেশে সরকারি কর্মসূচির অংশ হয়ে উঠেছে এই পদ্ধতি। এসব দেশে ধাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যাতে তাঁরা এটি প্রয়োগ করে প্রত্যন্ত পল্লি অঞ্চলের প্রসূতি মায়েদের জীবন রক্ষা করতে পারেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক অপারেশন টেবিলে ১৭ বছর আগে নিতান্ত অসহায় পরিস্থিতির চাপে উপস্থিত বুদ্ধি হিসেবে যে কৌশলের জন্ম হয়েছিল, তা এক ‘মেডিকেল মির্যাকল’ হিসেবে অনুকরণ করা হচ্ছে দেশে দেশে। ইউনিসেফ, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল, ওয়ার্ল্ড ভিশন, পাথফাইন্ডারসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে সায়েবাস মেথড
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সি-ব্লকের নবম তলায় অস্ত্রোপচার চলছে। সে দিন ১৬ আগস্ট, বুধবার। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি অপারেশনে থিয়েটারে (ওটি) চিকিৎসকেরা ব্যস্ত।
নির্ধারিত অস্ত্রোপচার শেষে বেলা ১১টায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজাউল করিমের। তিনি বলেন, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সায়েবাস মেথড’ ব্যবহার করা হয়। এটি ব্যবহার করা হচ্ছে সব সরকারি হাসপাতালেই। এ ক্ষেত্রে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে।
কথা বলার সময় পাশে ছিলেন একই বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদা জেবিন। তিনি বলেন, ‘এই প্রযুক্তির ব্যবহার শেখাতে আমি একাধিকবার ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছি। এটা যে শুধু আমাদের দেশের মায়েদের জীবন রক্ষা করছে তা নয়, অনেক দেশেই এর ব্যবহার আছে।’
২০১০ সালের সর্বশেষ মাতৃমৃত্যু জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মায়ের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৩১ শতাংশের মৃত্যু হয় রক্তক্ষরণজনিত কারণে। এটাই মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ।
অধ্যাপক ফাহমিদা জেবিন জানান, স্বাভাবিক বা অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবে অনেক প্রসূতির প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এটি বন্ধের প্রধান চিকিৎসা ওষুধ। কিন্তু ওষুধেও অনেক সময় রক্তক্ষরণ বন্ধ হয় না। তখন এই সায়েবাস মেথড ব্যবহার করা হয়।
মাত্র ১০০ টাকায় জীবন রক্ষা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক সায়েবা আক্তার। এখন সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘মামস ইনস্টিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেনস হেলথ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত সপ্তাহে সেই প্রতিষ্ঠানেই বসে কথা হয় অধ্যাপক সায়েবার। তাঁর মুখ থেকে শোনা যায় সায়েবাস মেথড উদ্ভাবনের গল্প।
সায়েবা আক্তার বলেন, ‘অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ বন্ধে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশেষ বেলুন ব্যবহার করতাম। বেলুন ইউরোপ থেকে আনা হয়েছিল। একটি বেলুনের দাম ৩০০ ডলারের (২৪ হাজার টাকা) মতো। এই বেলুন জরায়ুর মধ্যে স্থাপন করে তাতে পানি ঢোকানো হতো। ফোলা বেলুন জরায়ুর ভেতরের দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করত আর তাতেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হতো।’
ভালোই চলছিল। কিন্তু একসময় বেলুনটি হারিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা পড়ে গেলেন দুশ্চিন্তায়। সায়েবা আক্তার চোখের সামনে কয়েকজন প্রসূতির মৃত্যু দেখেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। বিষাদে ছেয়ে যায় চিকিৎসক সায়েবার মন। কিছু একটা করার কথা ভাবছিলেন তিনি। সেই সময় তাঁর মাথায় ওই বিশেষ বেলুনের পরিবর্তে কনডম ব্যবহারের চিন্তা উঁকি দেয়।
সে সময় প্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে একজন অল্পবয়সী রোগী মুমূর্ষু হয়ে পড়ে। তাকে বাঁচাতে বাধ্য হয়েই পরীক্ষামূলকভাবে এই কৌশল প্রয়োগ করেন ডা. সায়েবা। প্রথম পরীক্ষাতেই সাফল্য। সেটা ২০০০ সালের কথা।
পদ্ধতিটি অতি সরল। একটি ক্যাথেটারের মাথায় কনডম বাঁধা হয়। সেই কনডম জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। ক্যাথেটারের অন্য প্রান্তে স্যালাইন লাগানো হয়। পানি ঢোকার কারণে কনডম বড় হতে থাকে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করে। এভাবে ২৪ ঘণ্টা রাখা হয়। এরই মধ্যে রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।
ডা. সায়েবা বলেন, পুরো কিট তৈরি করতে ১০০ টাকার কম খরচ পড়ে। আর উপকরণগুলো এত সহজলভ্য যে গ্রামেগঞ্জে চাইলেই ধাত্রীরা এটা বানিয়ে নিতে পারবেন। দরকার শুধু প্রশিক্ষণ।
গবেষণার স্বীকৃতি
পদ্ধতিটি আপাতদৃষ্টিতে সরল হলেও এর একটি একাডেমিক স্বীকৃতির দরকার ছিল। সহকর্মী ও ছাত্রীদের নিয়ে একটি প্রায়োগিক গবেষণার উদ্যোগ নেন অধ্যাপক সায়েবা আক্তার। অন্যদের মধ্যে ছিলেন ডা. রাশিদা বেগম, ডা. জাকিয়া কবির, ডা. মালিহা রশিদ, ডা. তরফদার রুনা লায়লা ও ডা. ফাহমিদা জেবিন। ২০০১ সালের জুলাই থেকে ২০০২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা ১৫২ জন প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের রোগীকে নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁদের মধ্যে ২৩ জনের ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। গবেষণায় দেখা যায়, এই প্রযুক্তি দ্রুত কাজ করে এবং তা কার্যকর। এটা সহজে ব্যবহার করা যায়। এটার খরচ কম এবং নিরাপদ।
এই গবেষণা ফলাফল ২০০৩ সালে মেডস্কেপ জেনারেল মেডিসিন সাময়িকীতে ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মাতৃমৃত্যুর প্রাথমিক কারণ প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ। প্রসবে সেবায় যুক্ত যেকোনো কর্মী সহজ এই পদ্ধতি শিখে মায়ের জীবন রক্ষা করতে পারেন। এরপর থেকে এই পদ্ধতি প্রসূতিসেবায় সায়েবাস মেথড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সরকার তখন থেকে জরুরি প্রসূতিসেবার প্রশিক্ষণে সায়েবাস মেথড অন্তর্ভুক্ত করে।
এই পদ্ধতি সম্পর্কে অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি এবং বিশিষ্ট প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রওশন আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, যখন মায়ের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে, কিছুতেই আর কাজ হয় না, তখন রক্তক্ষরণ বন্ধে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এটা জীবন রক্ষাকারী একটি পদ্ধতি।
যেসব দেশে প্রয়োগ হচ্ছে
বাংলাদেশের বাইরে বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও পশ্চাৎপদ প্রযুক্তির দেশগুলোতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ সুদান, কেনিয়া, সিয়েরা লিওন, ঘানা, তানজানিয়া, সেনেগাল, জাম্বিয়া, উগান্ডা, পেরু, হন্ডুরাস ও ইন্দোনেশিয়া। অনেক দেশে এটি সরকারি স্বাস্থ্য কর্মসূচির অংশ।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
২০০৪ সালে ব্যাংককে জরুরি প্রসূতিসেবার ওপর একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মশালায় বিশ্বের সেরা গাইনি বিশেষজ্ঞদের সামনে অধ্যাপক সায়েবা তাঁর পদ্ধতি উপস্থাপন করেন। এরপর ২০০৬ সালে ভারতে এবং পাকিস্তানে পৃথক সেমিনারে সায়েবাস মেথডের ওপর উপস্থাপনা করেন। এই দুটি দেশে এখন এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।
ধীরে ধীরে এই পদ্ধতির ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে এর ব্যবহার। অধ্যাপক সায়েবা এবং তাঁর সহকর্মীরা ইন্দোনেশিয়ার অনেক দ্বীপে এই পদ্ধতির ওপর চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ডা. সায়েবা বলেন, ইন্দোনেশিয়ার সরকার প্রসূতিসেবা কার্যক্রমে আনুষ্ঠানিকভাবে সায়েবাস মেথড অন্তর্ভুক্ত করেছে। নেপাল ও পূর্ব তিমুরেও এটা ব্যবহৃত হচ্ছে।
২০০৯ সালে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ব্রিটিশ জার্নাল অব অবসটেট্রিকস অ্যান্ড গাইনোকোলজিতে এই পদ্ধতির ওপর পর্যালোচনা ছাপা হয়।
২০১৩ সালে অধ্যাপক সায়েবা আক্তার তাঁর উদ্ভাবিত এই পদ্ধতির মেধাস্বত্ব (পেটেন্ট) নিবন্ধন করেন সরকারের দপ্তরে।
এর আগে ২০১১ সালে যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিশিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্টসের পক্ষ থেকে তাঁকে তাঁর উদ্ভাবনের জন্য সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়া হয়।
ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘এই পদ্ধতি ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়ে যেমন মজা পেয়েছি, তেমনি আনন্দ পেয়েছি চোখের সামনে প্রসূতিদের সুস্থ হতে দেখে।’

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন