লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার ওসির ‘বেপরোয়া মামলা বানিজ্য


লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার ওসি মাহমুদুন নবীর বিরুদ্ধে ‘মামলা বাণিজ্যের’ অভিযোগে স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে প্রত্যাহারের দাবি ওঠার মাঝে নতুন কওে এবার মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এবারের অভিযোগকে ‘মামলা বানিজ্যের’ বিষয়টি আরও পরিস্কার বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মানুষজন।
মামলা বাণিজ্যে ‘বেপরোয়া’ ওই ওসির বিরুদ্ধে এবার খোদ আদালতের নির্দেশ উপেক্ষার অভিযোগ উঠেছে।
এজাহার সুত্রেই জানা গেছে, ২০১৯ সালের এক ঘটনাকে নিয়ে মোতাহার হোসেন মিন্টু নামের এক যুবদল নেতা গত বছরের ১২ নভেম্বর মামলা দায়ের করতে থানায় যান। তবে ‘ওসির পরামর্শে’ পরবর্তিতে তিনি আদালতের আশ্রয় নেন।
আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন ওই ওসিকে। কিন্তু তিনি প্রায় সাড়ে তিন মাসে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেননি, উল্টো একই ঘটনায় বাদীকে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া সেই ওসিই নতুন করে থানায় নিয়মিত মামলা নথিভুক্ত করেছেন। ওই ঘটনায় আদালতে দেওয়া অভিযোগে বাদী ৪৭ জনের নাম উল্লেখ করলেও থানায় দায়ের মামলায় ১০২ জন আসামীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে।
আদালতে দায়ের মামলায় মোতাহার হোসেন মিন্টুর অভিযোগে তিনি নিজের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল লালমনিরহাট জেলা শাখা উল্লেখ করেছেন।
গত বছরের ১৭ নভেম্বর আদালতে দায়ের অভিযোগে তিনি ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ার জেরে ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট নিজের বাড়িতে হামলার শিকার হন বাদী মোতাহার হোসেন মিন্টু।
এতে উল্লেখিত আসামীরা ছাড়াও অজ্ঞাত প্রায় আরও ৪০জন অংশ নিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন নিজ বাড়িতে আসামীদের দ্বারা যুবদল নেতা মিন্টুর নিজ বাড়িতে হামলার শিকার হন। এসময় তাঁর মা ও ভাইকেও মারধর করা হয়। এর পাশাপাশি আসবাবপত্র ভাঙচুর করে তিন লাখ টাকার ক্ষতি করা হয়।
এছাড়া নগদ আড়াই লাখ টাকা এবং বাছুরসহ ১৩টি গরু হামলাকারীরা বাড়ি থেকে নিয়ে যায় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘটনার পরপরই থানায় গেলেও সেসময়ের ওসি মামলা নেয়নি উল্লেখ করে মোতাহার হোসেন মিন্টু আদালতে দাখিল এজাহারে দাবি করেছেন, ওই ঘটনায় ‘গত বছরের ১২ নভেম্বর থানায় গেলে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বাদীকে আদালতের আশ্রয় গ্রহণের পরামর্শ দেন।’ উল্লেখ্য বর্তমান ওসি তারও দুই মাস আগে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর হাতীবান্ধা থানায় যোগদান করেন।
আদালত সূত্র জানায়, গত বছরের ১৭ নভেম্বর লালমনিরহাট আদালতে অভিযোগ দায়েরের পর শুনানী শেষে আদালত অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য হাতীবান্ধার ওসিকে নিদের্শ দেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, আদালতের নির্দেশনা না মেনে প্রায় সাড়ে তিন মাসেও সেই প্রতিবেদন জমা দেননি ওসি। উল্টো গত ৩ মার্চ একই ঘটনায় নতুন করে মোতাহার হোসেন মিন্টুর দেওয়া আবেদনের প্রেক্ষিতে একটি নিয়মিত মামলা নথিভুক্ত করেন (মামলা নম্বর-৮, তারিখ- ৩ মার্চ ২০২৫)।
থানায় দায়ের মামলার এজাহারে দেখা যায়, ১০২ জনের নাম উল্লেখসহ প্রায় ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আদালতে দায়ের অভিযোগে উল্লেখিত ৪৭ জনের পাশাপাশি থানায় দায়ের মামলায় নতুন করে ৫৫ জনকে আসামী হিসাবে দেখানো হয়েছে। এজাহারে ঘটনার তারিখ ও একই সময় উল্লেখ করে ওই ১০২জন সহ অজ্ঞাত প্রায় ৩০০ জনের বিরুদ্ধে বাড়িতে ঢুকে হামলার অভিযোগ করেছেন বাদী।
নিজেকে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদলের একজন সক্রিয় সদস্য’ উল্লেখ করে থানায় দায়ের মামলায় বাদী মোতাহার হোসেন মিন্টু এজাহারে দাবি করেন, ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন ও খুনী হাসিনার নির্দেশ বাস্তবায়নের বিপক্ষে অবস্থান স্পষ্ট থাকায়’ শত্রæতাবশত আসামীরা বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়। তাকে রক্ষা করতে গেলে তার মা ও ভাইয়ের ওপরও হামলা চালানো হয় এবং তিন লাখ টাকার আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়।
এছাড়া নগদ চার লাখ টাকা, স্বার্ণালকার, ফ্যান, মোবাইল এবং দুটি বাছুরসহ ১১টি গরু হামলাকারীরা লুট করে নিয়ে যায় বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। এতদিন পরে মামলা দায়েরের কারণ হিসাবে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেছেন, ‘ঘটনার সময় দেশের পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না’।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে লালমনিরহাটের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিজুল হক দুলাল বলেন, আদালতে বাদি মিন্টু ৪৭ জনের নাম উল্লেখ যে মামলাটি দায়ের করেছিলেন সেটি তদন্তের জন্য হাতীবান্ধার ওসির কাছে পাঠিয়েছিলেন। যার পিটিশন নাম্বার-৪৩৬। তিনি (ওসি) আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করেই একই ঘটনায় মামলা নিয়েছেন। যাকে আইনের চোখে সিআরপিসি ২০৫ এর বাড বলা হয়”।
জানা গেছে, দুটি মামলাতেই আসামী করা হয়েছে সাবেক জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। এর বাইরেও অনেক নিরীহ মানুষকেও আসামী করা হয়েছে বলে অভিয়োগ রয়েছে। যাদের অনেকেই ব্যবসায়ী। সেইসাথে কেউ কেউ কোন প্রকার রাজনীতির সাথে জড়িত নন বলে জানা গেছে।
আদালত ও থানায় দায়ের করা এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুটি আবেদনেই ঘটনার তারিখ, সময় ও স্থান একই উল্লেখ করা হয়েছে। আদালতে দায়ের মামলায় নগদ আড়াই লাখ টাকা ও বাছুরসহ ১৩টি গরু লুটের অভিযোগ করা হয়েছে। তবে থানায় নথিভ‚ক্ত মামলার এজাহারে নগদ চার লাখ টাকা, বাছুরসহ ১১টি গরু, স্বর্ণালংকারসহ অন্যান্য জিনিস লুটের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুই এজাহারেই কয়েকজন আসামীর ক্রম ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনার সময় ‘আহত’ বাদী হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে দুটি এজাহারে দুই রকম তথ্য উল্লেখ করেছেন। আদালতের অভিযোগে বলা হয়, হাতীবান্ধা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঘটনার দিন তার ভর্তি রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৪৭১৩, বেড : পুরুষ-৩)।
২০১৯ সালের ১৮ আগস্ট ‘চিকিৎসক অদৃশ্য কারণে বাদীকে ছাড়পত্র দেন’ বলে ওই এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। আর থানায় দায়ের মামলায় বলা হয়েছে, ঘটনার দিন বাদী মোতাহার হোসেন মিন্টুর ভর্তি রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৯৩১১/৩৮। এই আবেদনে কবে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে বাদি মোতাহার হোসেন মিন্টু‘র সাথে ফোনে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
যে ঘটনার বিষয়ে বাদিকে আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন সেই ঘটনায় আদালতের নির্দেশ ছাড়াই থানায় কীভাবে মামলা দায়ের করলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে হাতীবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুন-নবী সাংবাদিকদের বলেন, দুটি মামলার একটি বাতিল হবে। এরবেশি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন