লোক দেখানোর মশা নিধনে পানিতে ৫০ কোটি টাকা!
মশার উৎপাত রোধে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে। এজন্য বরাদ্দ ৫০ কোটি টাকা। তবে ঠিক যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যে, মশা মারতে দুই সিটির ক্রাশ প্রোগাম যতটা না কাজের, তার চেয়ে বেশি লোক দেখানো। মূলত ৫০ কোটি টাকা পানিতে ঢালার ব্যবস্থা করছে সিটি করপোরেশন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রাশ কর্মসূচিতে কার্যকর কিছু হবে না। কারণ, সিটি করপোরেশেন শুধু স্প্রে করবে। এতে সাময়িক মশার উৎপাত বন্ধ হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ফলাফল শূন্য। লার্ভা ধ্বংস না করে স্প্রে মশার বংশবিস্তার রোধ করতে পারবে না।
অনুসন্ধান ও সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মশার শত শত ব্রিডিং স্পটের তুলনায় লোকবল ও ওষুধ কম। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা, ঢাকার অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা এবং সমন্বয়হীনতার কারণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে মশা নিধন।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর চারদিক ঘিরে শত শত মশা উৎপাদক চারণভূমি তৈরি হয়ে আছে। এর বাইরে মাইলের পর মাইল ড্রেন, সুয়ারেজ লাইন, অসংখ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটছোট জলাধারে কোটি কোটি মশার লার্ভা তৈরি হচ্ছে, যা ধ্বংস করার সাধ্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেই।
জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চলতি অর্থ বছর মশক নিধনে বরাদ্দ আছে প্রায় ২৪ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল ২০ কোটি টাকা। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রায় ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে, যা গত বছর ছিল ২৫ কোটি টাকা।
গত বছর চিকুনগুনিয়ার ব্যাপক প্রকোপ এবং সিটি করপোরেশনগুলোর পরিধি বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট বাড়ানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে সরেজমিনে মশার বংশবিস্তারের ভয়াবহ রূপ দেখা গেছে। এ সময় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এবং মশক গবেষক কবীরুল বাসার।
তিনি তার ছাত্রদের নিয়ে মশার লার্ভা উৎপন্ন হয় এমন বেশ কিছু জায়গা সনাক্ত করে মশার ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধির আশঙ্কার কথা বলেন।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার ঢাকা উদ্যান, নবীনগর হাউজিং, হাজারীবাগ হয়ে শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও এলাকায় অসংখ্য খাল, নর্দমা এবং সিটি করপোরেশনের ড্রেনে স্তূপ হয়ে থাকা মশার লার্ভা তুলে দেখান কবীরুল বাসার।
তিনি জানান, এমন আরও শত শত মশার লার্ভা তৈরির স্পট ছিটিয়ে আছে পুরো নগরীতেই।
কবীরুল বাসারকে নিয়ে যখন ঘুরছি, ফগার মেশিন নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক মাঠকর্মীকে শেরেবাংলা নগরের ফুটপাতে পাওয়া যায়। তিনি সমানে মশা মারার ওষুধ ছিটালেও তা কোনোভাবেই ড্রেন এবং নর্দমায় দিচ্ছিলিন না। এমনকি এর কাছাকাছি একাধিক জায়গাতেও স্তূপ হয়ে থাকা মশার লার্ভা দেখা যায়।
এসব দেখে কবীরুল বাসার নিজেই প্রশ্ন তোলেন, তাহলে কীভাবে মশা ধ্বংস হবে?
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ধুমধামের সঙ্গে মশা নিধনের ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হলেও বাস্তবে ছিটেফোটাও দেখতে পারছেন না এলাকাবাসী।
গত দু’দিন ধরে রাজধানীর মগবাজার, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর এলাকার অসংখ্য বাসিন্দা জানান, তারা গত কয়েক মাসে তাদের এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেননি।
মোহাম্মদপুর এলাকার গৃহিনী সুলতানা শারমিন বলেন, ‘আপনারা বাইরে কি মশা দেখছেন, ঘরে আসুন, দেখবেন মশা কাকে বলে? গায়ের ওপর এমনভাবে বসে যে, হাত দিয়ে ঘষেও দূর করা যায় না।’
কবিরুল বাসার বলেন, ‘এখন যে পরিমাণ মশার লার্ভা তৈরি হয়েছে, তা কেবল রাস্তা-ঘাটে ওষুধ ছিটিয়ে নির্মূল করা যাবে না। এজন্য মশার লার্ভা ফোটে এমন জায়গাগুলো ধ্বংস করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটা বৃষ্টি হওয়ার পরপরই প্রথম কয়েক দিনে কোটি কোটি মশার লার্ভা ফুটে বেরিয়ে আসবে। সেগুলো হয়তো বেশি বৃষ্টি হলে তারপর পুরোপুরি ধ্বংস হবে।’
কবিরুল বাসার বলেন, ‘এখন যেসব মশা আছে, সেগুলো কিউলেক্স মশা। সেগুলো কোনো রোগ তৈরি না করলেও মানুষের জীবন অতিষ্ট করে তোলে কামড় আর শব্দ করে।’
তিনি বলেন, ‘এরপরই ভয়াবহ আশঙ্কা নিয়ে আসতে পারে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া তৈরির ঝুঁকি নিয়ে এডিস মশা।’
সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে হস্তচালিত স্প্রে মেশিন আছে ৫৬৭টি, যার ২৫০টিই অকেজো। একই দশা ফগার মেশিনের, ৩১৫টির মধ্যে কাজ করে না ৬০টি। আর ২২টি হুইল ব্যারো মেশিনের ১২টিই নষ্ট।
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে হস্তচালিত স্প্রে মেশিন আছে ৫৬২টি। এর মধ্যে অকেজো ২১২টি। ফগার মেশিন রয়েছে ৪৫২টি, অকেজো ২১২। হুইল ব্যারো মেশিন আছে ৫১টি, যার ৩০টিই নষ্ট।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় যতগুলো এলাকায় ড্রেন আছে, সেগুলো বেশিরভাগ মশার উৎপত্তিস্থল। সেসব ড্রেনের বেশিরভাগেই দোকানপাট দিয়ে বেদখল হয়ে আছে। আমরা সেসব জায়গায় এপ্রোচটা ঠিকমতো করতে পারছি না। এক একটি ড্রেনের সামান্য অংশে হয়তো মশা নিধনের স্প্রে করা যায়। কিন্তু, এক একটি ড্রেনের ৭০-৮০ ফুট জায়গায় কোনোভাবেই স্প্রে করা যায় না। এ কারণে সম্পূর্ণ মশা নিধনও সম্ভব হচ্ছে না। এ সমস্ত জায়গাগুলো মশার উপযুক্ত স্পট। এসব জায়গায় সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া কিছু করা সম্ভব না।’
তিনি স্বীকার করেন, ‘এসবের বাইরে অনেক জলাশয় আছে, আনাচে-কানাচে জায়গা আছে, যেখানে আমরা সেভাবে কাজটা করতে পারছি না। তাই কার্যকর ফলটা আমরা পাচ্ছি না।’
ঢাকা উত্তর সিটির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলীসহ সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। শুধু সিটি করপোরেশন পারবে না। ওয়াসা আছে, রাজউক আছে, তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে আমার মনে হয়, কোথায় যেন সমন্বয়ের একটা অভাব আছে।’
তিনি আরও জানান, চাইলে মাঠকর্মীদের ওপর সঠিক নজরদারি করা যাচ্ছে না। কারণ, তাদের দেখভালের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা দিক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের হাতে বেশ কিছু যন্ত্রপাতির সংকট আছে। আরও কিছু নতুন যন্ত্রপাতি কেনার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তবে আমরা মশা নিয়ে নগরবাসীর দুর্ভোগ লাঘবের চেষ্টা করছি।’ সূত্র : পরিবর্তন ডটকম
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন