শিক্ষক ও শিক্ষকতা

মানুষ সৃষ্টির সেরা। জন্মগত সেরা হলেও জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়ে সেরা হতে হয়। আর জ্ঞান অর্জনের অন্যতম মাধ্যম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চালিকাশক্তি শিক্ষক। যেকোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল স্তম্ভই শিক্ষক। শিক্ষকই একটি সমাজ বদলে দিতে পারেন উন্নত মানুষ তৈরির মাধ্যমে।

নির্দ্বিধায় বলা যায়- যে দেশের শিক্ষক ও শিক্ষাব্যবস্থা যত উন্নত সে দেশ তত বেশি অগ্রগামী। শিক্ষাতরীকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব শিক্ষকের। সেই তরীর মাঝি উপযুক্ত না হলে মাঝপথে থেমে যেতে পারে যাত্রা। কথায় আছে- “আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শেখায়”। জগে পানি থাকলেই মগে ঢালা সম্ভব।

শিক্ষকতার মতো মহান ব্রত যা বহু সাধনায় অর্জন করতে হয়। পেস্তালজি তার বিখ্যাত পুস্তক Leonard and Gertrude এ বলেছেন, ‘বাবা- মা যা দিতে পারেননি সন্তানদের, শিক্ষকদের তা অবশ্যই দিতে হবে।’ শিক্ষকগণ তাই দিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর।

শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আর শিক্ষার মেরুদন্ড শিক্ষক। শিক্ষককে জীবন্ত উপাদান নিয়ে কাজ করতে হয় বলেই শিক্ষকতা একটি উঁচুদরের শিল্প।

স্যার জন অ্যাডামস শিক্ষককে ‘মানুষ করার কারিগর’ বলেছেন। পার্সিভেল রেন বলেছেন, ‘শিক্ষক শুধু খবরের উৎস বা ভান্ডার নন, কিংবা প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার তথ্য সংগ্রহকারী নন, শিক্ষক শিশুর বন্ধু, পরিচালক ও যোগ্য উপদেষ্টা, একজন সুদক্ষ শরীর গঠনকারী, শিশু মনে বিকাশ সাধনে সহায়ক তথা তাদের চরিত্র গঠনের নিয়ামক।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে-‘ উত্তম শিক্ষক হবেন উত্তম ছাত্র, শিক্ষকের ছাত্রত্ব গ্রহণে তার মনের তারুণ্য নষ্ট হতে পারে না বরং তিনিই সবসময় ছাত্রদের সুবিধা- অসুবিধা ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হবেন এবং এ কারণেই শিশুদের মনের একান্ত কাছাকাছি থাকবেন।’ ফ্রোয়েবলের কথায়- ‘শিক্ষকের কাজ ফুল বাগানের মালির কাজ! শিশু চারার লালন, পোষণ ও রক্ষণের কাজ।

এই চারার সবুজ পাতা, রঙিন ফুল এবং সুস্থ সুপুষ্ট ফল ধরানোর কাজ।’ একজন ভাস্কর যেমন তার চেষ্টা সাধনায় একটি শিল্প কর্ম তৈরি করেন ঠিক একজন শিক্ষক তার সমস্ত জ্ঞান -সাধনা দিয়ে উপযুক্ত মানুষে পরিণত করেন।

শিক্ষার সংজ্ঞায় ফ্রোয়েবল বলেন, ‘ব্যক্তি মানুষের জীবনে বিবর্তনের ধারায় যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় এবং জীবনের বিকাশ ও প্রকাশে যে ক্রমোন্নতি ঘটে তাই শিক্ষা।’ শিশু মনের বিকাশ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষকের বিকল্প নেই। ফুল যেমন সূর্যের সাহায্যে বিকশিত হয় একজন ছাত্রের বিকাশ ও প্রকাশে শিক্ষক অনুঘটক হিসেবে কাজ করেন। তাই সুষ্ঠু সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকের ভূমিকা সবচাইতে বেশি।

শিক্ষক শিক্ষার্থীর গুণগত পরিবর্তনে কাজ করেন। এই কাজটি শুধু আন্তরিক প্রচেষ্টায় সম্ভব। আমি মনে করি, চাকরি ও শিক্ষকতা এক নয়। যেকোনো পেশার কাজের পরিমাপ করা যায় কিন্তু শিক্ষকতার পরিমাপক নেই। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানে থাকাই শেষ কথা নয়।

শিক্ষকতা পেশায় শিক্ষকের চলনে- বলনে, চিন্তা -চেতনায়, ধ্যানে -জ্ঞানে এক কথায় আপাদমস্তক শিক্ষক হতে হয়। পরিবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ উপস্থাপন রীতির পরিবর্তনটাও শিক্ষককেই শিখতে হয়। শিক্ষককে তার পুরো নিবেদন থাকতে হয় তার পেশায়। তিনি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও নিজেকে শিক্ষক হিসেবে তৈরি করেন।

প্রচুর বই পড়েন, প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত খোঁজখবর রাখেন। শিক্ষার্থী মূল্যায়নে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দেন। তাই বলা যায়-চাকরি যত সহজ শিক্ষকতা ঢের কঠিন। শিক্ষকের বাকশৈলী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকের কাঙ্ক্ষিত বাচনভঙ্গি শিক্ষার্থীরা সবসময় প্রত্যাশা করে।

শিক্ষকের প্রমিত উচ্চারণ, কণ্ঠের উঠানামা এসব শিক্ষার্থীরা খুবই উপভোগ করে। শিক্ষক ভাষা দূষণের হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করেন। শব্দের ঠিক বানান শেখার কাজটি শিক্ষকই করে থাকেন। সেজন্য শিক্ষককেই সর্বাগ্রে ভাষার পাণ্ডিত্য অর্জন করা বাঞ্ছনীয়।

অনেক শিক্ষককে দেখেছি শিক্ষক পরিচয়ের চেয়ে অন্য পেশার পরিচয়ে বেশি পরিচিত। অর্থাৎ বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড় হতে দেখা যায়। কেউ পুরোদুস্তর রাজনীতির নেতা। তিনি সর্বক্ষেত্রে রাজনীতির পদবি দিয়ে নিজের পরিচয় দেন। কেউ আবার ঠিকাদার,সাংবাদিক,হাতুড়ে ডাক্তার, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইত্যাদি পেশায় নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলেছেন। তারা ভুলেই যান তিনি শিক্ষক।

বট গাছ যেভাবে অন্য গাছকে গিলে ফেলে তেমনি শিক্ষকের সহপেশা শিক্ষকতাকে ধীরে ধীরে গিলে খায়। যদিও আমাদের দেশে শিক্ষক অন্য পেশায় যাওয়ার জন্য আর্থিক কারণই অন্যতম। শিক্ষক তার পেশা ও গবেষণায় নিবেদন কমে গেলে মগজে শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান, পেশাদারত্ব থাকে না। তখন তার মেজাজটা বাড়তে থাকে।

মগজ না থাকলে মেজাজ থাকবেই। শাসন বারণ থাকলেও শিক্ষকের মেজাজের কারণেও অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে সন্দেহ নেই। অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ান যা নিঃসন্দেহে ভালো। তবে প্রাইভেট না পড়লে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় অকৃতকার্য করানোর ঘটনাও শোনা যায় যা অস্বস্তিকর।

যাঁরা প্রাইভেট পড়ান তাদের অনেকেই শ্রেণিপাঠে আন্তরিক থাকেন না। আবার শ্রেণিপাঠে আন্তরিক থাকলেও প্রাইভেট পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণে আগ্রহ হারায়। কারণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ প্রাইভেটে। যদ্বরুন কিছু শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠান নির্ভর না হয়ে প্রাইভেট নির্ভর হয়।

সাধারণত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ তুলনামূলক ভালো শিক্ষক বলে মনে করা হয়। তাদের প্রতিষ্ঠানের ফলাফল বরাবরই ভালো হওয়ার কথা। কিন্তু অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ফলাফল সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও ভালো। কারণ যাই থাকুক আমার মনে হয়, শিক্ষকের আন্তরিকতা ও তার নিবেদনের উপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

একটি চারা গাছ যতই উর্বর জমিতে রোপণ করা হোক না কেন নিবিড় পরিচর্যা ছাড়া ঠিকভাবে বেড়ে উঠে না। তেমনি শিক্ষার্থীর পরিচর্যা ছাড়া তারাও ঠিকভাবে বেড়ে ওঠে না। মানবসম্পদপূর্ণ দেশে নিবেদিত শিক্ষক খুব বেশি প্রত্যাশার।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক কিংবা প্রতিষ্ঠান এখনও নন এমপিওভুক্ত। রীতিশুদ্ধভাবে শিক্ষক শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত থাকলেও এমপিও ভুক্ত হননি। ইসলাম ধর্মে- শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধের বলা হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি অনেক শিক্ষক এমপিওর আশায় তাদের মূল্যবান জীবন, যৌবন ও সময় হারাচ্ছেন। তবুও রাষ্ট্র এমপিও দিতে পারে নাই।

যদ্বরুণ কারও বিয়ে হয়নি আবার কেউ স্ত্রী -সন্তানের ন্যূনতম আবদার পূরণ করতে পারেন না। শিক্ষক সমাজে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার পরিবর্তে মানবেতর জীবন যাপন করেন। সৈয়দ মুজতবা আলী তার পাদটীকা রচনায়- পন্ডিত মশায়ের মাসিক বেতন ২৫/ টাকা আর শিক্ষা কর্মকর্তার তিন পা ওয়ালা কুকুরের পেছনে মাসিক খরচ ৭৫/ টাকা।

এমন উদাহরণ দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের সংস্কৃত শিক্ষকের আর্থিক দৈন্যের বাস্তব ছবি এঁকেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে উন্নয়নশীল দেশে নন এমপিও শিক্ষকগণকে নিয়ে পাদটীকার চেয়েও হৃদয়স্পর্শী গল্প লিখতেন সন্দেহ নেই।

শিক্ষকের মর্যাদা এখনও কিতাবে বাস্তবে যৎসামান্য। তারা এখনও মৌলিক চাহিদার জন্য রাজপথে নামেন। শিক্ষার্থীকে শাসন করতে না পারলেও শিক্ষক বিশ্ববাসীর সামনে রাষ্ট্রের চোখ রাঙানি, শাসন -বারণ এমনকি লাঠিপেটা পেয়ে আহত হন। আহত শিক্ষক লজ্জায় মাথা নত করে আবার দাঁড়ান শিক্ষার্থীর সামনে। দেশে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক থাকলেও তাদের চিকিৎসার জন্য নেই স্বতন্ত্র হাসপাতাল। এমনকি তাদের আর্থিক লেনদেনের জন্য নেই কোন স্বতন্ত্র ব্যাংক।

শিক্ষক মানেই অনেকে অগত্যা মধুসূদন। পছন্দের চাকরি না পেয়ে শিক্ষকতা করা। যেদিন মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষক শীর্ষে থাকবেন সেদিন দেশের প্রথম শ্রেণির মেধাবীরা প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিবে এই মহান পেশা। আর তখনই নির্মাণ হবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।

ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের কাতারে লেখা থাকবে প্রিয় দেশের নাম। বাস্তবে রূপ নেবে কাজী কাদের নেওয়াজ এর কবিতার চরণ-‘ শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার দিল্লির পতি সে তো কোন ছার…।’

লেখক: মো.আব্দুছ ছালাম
সহকারী অধ্যাপক
দইখাওয়া আদর্শ কলেজ
হাতীবান্ধা, লালমনিরহাট।