শুধু মেয়ের জন্য স্টেশনে ভিক্ষা করেন মা
লোকে তাঁকে পাগলি বলে, সে কথায় কান দেন না সবিতা। ঘুরে বেড়ান নৈহাটি স্টেশনের এ-প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে। মেয়েটার পড়াশোনা আর হোস্টেলের খরচ দিতে হবে তো।
মেয়ে সুনীতা (নাম পরিবর্তিত) ছাড়া তিন কুলে তাঁর আর আছে কে? শুনে সবিতা মৃদু প্রতিবাদ করেন, আমার সংসারে রয়েছে রোজ ট্রেনে যাওয়া আসা করা মানুষগুলো। ওদের কাছে হাত পেতেই দু’বেলার খাবারের টাকা জোটে।
তার থেকেই কিছুটা বাঁচিয়ে আঁচলে লুকিয়ে রাখেন সবিতা। কখনও সেই টাকাও খোয়া যায়। মেয়ের কথা ভেবে আবার ভিক্ষের ঝুলি ভরতে শুরু করেন মা।
মালা গাঁথার মতো একটু একটু করে আবার টাকা জমাতে থাকেন। কখনও মাসে এক বার, কখনও দু’মাসে এক বার মেয়ের সঙ্গে দেখা করে সেই টাকা দিয়ে আসেন।
রবিবার দুপুরের নৈহাটি স্টেশন। মেয়ের প্রসঙ্গ পাড়তেই সলজ্জ হাসি খেলে যায় সবিতার চোখেমুখে, ও…! তুমি জানো! আমি মেয়ের কাছে যাই তো।
এই যেটুকু কথা হল এত ক্ষণ, সেটা সবিতা দাসের জীবনকাহিনির দ্বিতীয় পর্ব। সেখানে রয়েছে স্কুলপড়ুয়া এক মেয়ে আর তার ভিখারিনি মা। আর প্রথম পর্ব? সে কাহিনি শিহরণ জাগানো অত্যাচারের। বাবা-মা, ছেলেবেলার ঘরবাড়ি ছেড়ে শ্বশুরঘরে যাওয়া এক নাবালিকার নরকযন্ত্রণা ভোগের গল্প।
গল্পের উৎস অবশ্য রাজ্যের ডব্লিউবিসিএস অফিসারদের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। সম্প্রতি নৈহাটি স্টেশন দিয়ে যাওয়ার সময়ে সবিতাকে দেখেছিলেন ডব্লিউবিসিএস সামসুর রহমান।
কৌতূহলবশতই শুরু করেছিলেন কথাবার্তা। সব কথা শুনে অবাক হয়ে যান সামসুর। পরে সবিতার ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী পোস্ট করেন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে।
হালিশহরে বাড়ি ছিল সবিতাদের। বাবা-মা, তিন ভাই নিয়ে সংসার। বাবা ছিলেন সব্জি বিক্রেতা। ১৩ বছর বয়সে জোর করেই সবিতার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল অযোধ্যার এক ছেলের সঙ্গে।
সে অনেককাল আগের কথা। এখন আর স্বামীর নাম মনে নেই। নিজের বয়সও ঠিক ঠাওর করতে পারেন না। তবু সবিতার মনে পড়ে, আমার বাবার নাম ছিল অনিল। মা লক্ষ্মী। বাবা-মা দু’জনেই মরে গিয়েছে। স্বামী ছিল হিন্দুস্তানি।
আপনার এই অবস্থা কেন? ছলছলে চোখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবিতা বলেন, শুধু স্বামী নয়, আমার ওপর জন্তুর মতো অত্যাচার চালাত শ্বশুরও। আমার শাশুড়ি ছিল না। দিনের পর দিন চলত ওদের অত্যাচার।
বাবা-ছেলের সেই যৌথ অত্যাচারের ফলে বারবার গর্ভবতী হয়ে পড়েন সবিতা। জন্মায় এক ছেলে, দুই মেয়ে। তারা সবাই জন্মের পরেই মারা যায়।
কথা থেমে যায়…। একটু সামলে নেন সবিতা। তার পর আবার শুরু করেন— সুনীতা যখন পেটে, তখন এক দিন লুকিয়ে পালিয়ে এলাম। কিন্তু হালিশহর ফিরে জানলাম, বাবা-মা আর নেই। ওই অবস্থাতেই তখন গেলাম দুই দাদার কাছে। ওরা তাড়িয়ে দিল।
সেই থেকেই শুরু সবিতার স্টেশন-জীবন। কিন্তু এক জন সহায়-সম্বলহীন তরুণী কী ভাবে, কোথায়, কোন পরিস্থিতিতে সুনীতার জন্ম দিল? প্রশ্নটা করতেই চোখ নামিয়ে নিলেন সবিতা। এ নিয়ে আর কথা বলেননি তিনি।
তবে সুনীতার কথা বলতেই আবার চিকচিক করে ওঠে চোখ দু’টো। মেয়ের সঠিক বয়স অবশ্য আন্দাজ করতে পারেন না মা। শুধু জানালেন, হাওড়া এলাকার এক হস্টেলে রেখে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
তারই জন্য ভিক্ষে করে টাকা জমাচ্ছেন। জমানো কয়েক হাজার টাকা এক বার ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নেশাখোরের দল। নৈহাটির আগে কোথায় ছিলেন?
সবিতা বলেন, ব্যান্ডেল স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে থাকতাম। কিন্তু ডেনড্রাইট পার্টিরা (স্টেশন চত্বরে যে কিশোর ও যুবকের দল ডেনড্রাইট দিয়ে নেশা করেন) খুব অত্যাচার করত। তাই পালিয়ে এলাম এখানে। সূত্র- আনন্দবাজার
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন