শেখ হাসিনাকেই বারবার টার্গেট করেছিলেন মুফতি হান্নান!
গ্রেনেড হামলার আগে ও পরে সারাদেশে বিভিন্নস্থানে মোট ১৩ নাশকতামূলক ঘটনারও পরিকল্পনাকারী ছিলেন জঙ্গি নেতা মুফতি হান্নান। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ১০১ জন। আহত হয়েছে ৬০৯ জন। মুফতি হান্নানের নাশকতামূলক এসব হত্যা ও হত্যাচেষ্টার মোট মামলা হয়েছে ১৭টি। এসব মামলার বিচার শেষ হয়েছে মাত্র দুটি। আরও ১৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
এর মধ্যে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে মুফতি হান্নানসহ তিন জঙ্গির ফাঁসি ও দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। এ মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন করে মহামান্য হাইকোর্ট আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনাল-১ এ আপিল করা হলে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল শুনানি শেষে ফাঁসি বহাল রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
এ ছাড়া ২০০১ সালে রমনায় বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা মামলায় হান্নানসহ হুজির আট জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মুফতি হান্নানসহ আট জঙ্গির ফাঁসির কার্যকর করার রায় দেয়া হলেও অন্য মামলার কার্যক্রম শেষ না হওয়ার কারণে তাদের ফাঁসি কার্যকর করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
২০০৫ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর হামলার ১৪ মাস পর ২০০৫ সালের ১ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডার বাসা থেকে গ্রেফতার হন মুফতি হান্নান। এরপর বিভিন্ন মামলায় ১৫০ দিন রিমান্ডে ছিলেন তিনি। ১৫০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে মুফতি হান্নানের বিষয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ওই সূত্র জানায়, মুফতি হান্নানকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গোয়েন্দাদের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করাসহ ১৭টি হামলায় জড়িত থাকার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, মুফতি হান্নানের বিরুদ্ধে ১৭ মামলার মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা, ২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রেখে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দুটি, ২০০১ সালে সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ঘটনায় দুটি মামলা। সিলেটে সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে করা মামলা।
২০০৫ সালে হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় করা দুটি মামলা, ২০০১ সালে সিলেটে নির্বাচনী জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলা এবং একই বছর সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন কামরানকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা মামলা।
২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে বোমা হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলা। ১৯৯৯ সালে খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলার ঘটনায়। মুফতি হান্নান ২০০৬ সালের ১৯ নভেম্বর এবং ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর দুই দফায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এসব হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিবরণ দেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
মুফতি হান্নানের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া। তার জবানবন্দি থেকে জানা যায়, তিনি গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা ও বরিশালের শর্ষিনা আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। এরপর ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে দাওরা হাদিস পড়াকালে ১৯৮৭ সালে ওই দেশের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক শিক্ষায় স্নাতকোত্তর পাস করেন।
পরের বছর ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানে যান এবং করাচির জামিয়া ইউসুফ বিন নূরিয়া মাদ্রাসায় ফিকাহ শাস্ত্রে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি সীমান্তবর্তী শহর খোস্তে মুজাহিদ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে আহত হয়ে তিনি পেশোয়ারে কুয়েত আল-হেলাল হাসপাতালে ১০ মাস চিকিৎসা নেন। এরপর করাচির ওই মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করেন।
মুফতি হান্নান ১৯৯৩ সালে দেশে ফেরেন এবং পাকিস্তানভিত্তিক হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়ে তৎপরতা শুরু করেন। অবশ্য এর আগেই আফগানফেরত এদেশীয় মুজাহিদরা হুজি-বি গঠন করেন। মুফতি হান্নান ১৯৯৪ সালে হুজি-বিতে যোগ দেন। প্রথমে তিনি কোটালীপাড়া উপজেলার থানা প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পান। সাংগঠনিক দক্ষতায় অল্প দিনের মধ্যে তিনি হুজি-বির অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসেন। হুজিতে থাকার পাশাপাশি মুফতি হান্নান হরকাতুল মুজাহিদীনের হয়েও কার্যক্রম চালাতেন বলে জানা গেছে।
১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে এ দেশে গোপন জঙ্গি সংগঠন হুজি-বির নাশকতা শুরু হয়। হুজি-বির কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সিদ্ধান্তে মুফতি হান্নান ও মুফতি আবদুর রউফের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় এ হামলা হয় বলে হান্নানের জবানবন্দিতে উল্লেখ রয়েছে। ওই হামলায় ১০ জন নিহত ও দেড়’শ জন আহত হন। যদিও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ ঘটনায় বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ফলে জঙ্গিদের বিষয়টি তখন আড়ালেই থেকে যায়।
এরপর একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনা শহরের আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা হয়। তাতে আটজন নিহত হন। ২০০০ সালের জুলাইয়ে কোটালীপাড়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভাস্থলের কাছাকাছি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখে প্রথম আলোচনায় আসেন মুফতি হান্নান ও তাঁর দল। এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে থেকে তৎপরতা চালান।
২০০১ সালে ঢাকায় সিপিবির সমাবেশে, রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানসহ ছয়টি বোমা হামলার ঘটনা ঘটায় জঙ্গিরা। এরপর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তার সমাবেশে। এতে আওয়ামী লীগের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ শতাধিক ব্যক্তি।
তার আগে ওই বছরের ২১ মে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে বাংলাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর এবং ৭ আগস্ট সিলেটের তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ওপর গ্রেনেড হামলা চালায় হুজি-বির জঙ্গিরা। হান্নানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় সর্বশেষ গ্রেনেড হামলা হয় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জে এক সমাবেশে। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন