‘শ্যামল কান্তির সঙ্গে কারাগারে বাংলাদেশ’
লীনা পারভীন : শ্যামল কান্তিকে পুলিশ জেলে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটা ভিডিও দেখছিলাম। পুরোটা দেখার মতো মানসিকতা অর্জন পারিনি। কারণ ছোটবেলায় প্রায় প্রতিটা মুহূর্তে শিখেছি শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি। কবিতা পড়েছি, গদ্য পড়েছি। বাবা মায়ের কড়া আদেশ ছিল শিক্ষকের মুখে মুখে তর্ক করা যাবে না, ক্লাসে শিক্ষক যা বলবেন মাথা পেতে আদেশ মনে করে নিতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যে খারাপ ভালো দুইটাই ছিল কিন্তু খারাপ শিক্ষকের ব্যাপারেও কথা বলার সময় মাথায় রাখতাম আমি একজন শিক্ষকের ব্যাপারে কথা বলছি। এটাইতো ছিল শিক্ষা।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনও আমার সন্তানদের এই একটা বিষয়ে কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছি। একবার স্কুল থেকে অভিযোগ এলো আমার ছেলে ক্লাসে শিক্ষকের কথা শুনে না, অমনোযোগী এবং একবার মুখে মুখে কথাও বলেছে। বাসায় এলে যখন জিজ্ঞেস করলাম কারণ কী? কেন তুমি তর্ক করেছো? ছেলে চেষ্টা করেছিলো তার আচরণের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে কিন্তু আমি একটা জায়গায় পরিষ্কার সিদ্ধান্ত দিয়েছি, যাই হোক বা শিক্ষক ভুল করুক বা ঠিক করুক অন্তত শিক্ষকের মুখে মুখে কথা বলা যাবে না। নট এলাউড। কখনও কখনও কিছু বিষয়ের ব্যাপারে অগণতান্ত্রিক আচরণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং সেটা করতে আমি কখনও পিছ পা হই না।
আজকাল স্কুলগুলোতে শিক্ষক আর ছাত্রকে আলাদা করা যায় না। সবাই বন্ধু হয়ে যায়। একটা স্লোগান কিছুদিন আগে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো, ‘সবকিছু বদলাতে নেই’। আমিও মনে করি সমাজ থেকে সবকিছুই বদলে ফেলতে হয় না।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী সবসময় ভালো ভালো কথা বলে থাকেন। বিশেষ করে সামাজিক এবং নৈতিকতার বিষয়গুলোকে তিনি অত্যন্ত প্রাধান্য দিয়ে কথা বলেন। এমনকি কিছুদিন আগে তিনি তার কোনও এক বক্তৃতায় শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়েও কথা বলেছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান এখনও ভুলে যাননি সমাজে একজন শিক্ষকের স্থান কী হওয়া উচিত। তাহলে শ্যামল কান্তিদের কেন এমন মাথা নিচু করে স্তম্ভিত মুখে জেলে যেতে হয়?
সমাজে প্রতিনিয়ত অনাচারের হার বেড়েই চলেছে। একে একে ধস নেমে আসছে প্রতিটা কাঠামোতে। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, নারী নির্যাতন এখন যেন নিত্যদিনের কর্মে পরিণত হয়েছে একদল মানুষের জন্য। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কী পরিমাণ অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা চলছে সেটা প্রতিদিনের পত্রিকা পড়লেই বুঝা যায়। এই সে দিনও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মিলিয়ন ডলার সরানো হলো এক হ্যাকিং ঘটনায়, একই রকম আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটে চলেছে বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক থেকে শুরু করে অন্যান্য ব্যাংকগুলোতেও। হাজার কোটি টাকা ঋন অনাদায় থাকছে বছরের পর বছর। এদেশের পুঁজি বাজার থেকে হাওয়া হয়ে যায় হাজার হাজার মানুষের রক্তেভেজা কোটি কোটি টাকা। কই এখনোতো দেখিনি একটি টাকাও উদ্ধারের কার্যকর তৎপরতা।
স্কুলের পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি এখন চাকুরির পরীক্ষাতেও চলছে প্রশ্ন ফাঁসের মতো নির্লজ্জ ঘটনা। শিক্ষা এখন আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসার নাম। প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত আছে অনেক শিক্ষক নামের কুলাঙ্গাররাও। কই পুলিশের হাতকড়া কেন ওদের হাতে পড়ে না? প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে কয়জনকে গ্রেফতার করেছে আমাদের করিতকর্মা পুলিশ? কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? কয়জনের বিরুদ্ধে কোর্ট রায় দিয়েছে জেলে নিয়ে যাওয়ার? তাহলে কী ধরে নেব এদেশে অন্যায় করাটাই ন্যায়ের মানদণ্ড? যারা প্রশ্ন ফাঁস করবে না, যারা শেয়ার বাজার থেকে অর্থ লুট করবে না, যারা ব্যাংক ডাকাতি করবে না তারা এই সমাজে অচল মানুষ হিসাবেই গণ্য হবে?
উত্তর যদি না হয়, তবে শ্যামল কান্তির অন্যায় আমাকে ব্যাখ্যা করে দিন মাননীয় বিচারক। শ্যামল কান্তি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে আপনার আমার জন্য একটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন। তিনি কি কখনও ভেবেছিলেন তার স্বপ্নের বাংলাদেশ তার হাতে পুলিশের শৃঙ্খল পড়াবে? তিনি কী ভেবেছিলেন যে মহান ব্রত নিয়ে তিনি শিক্ষকতার মতো মানুষ গড়ার পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন সেই পেশাই তার কাল হবে? তিনি মানুষ গড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু ধরা খেয়েছেন কিছু অমানুষের কাছে কারণ তিনি অমানুষদের দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হননি। তিনি কোন মাস্তানের কাছে নিজেকে বিক্রি করতে চাননি। তাহলে কী এই সমাজে বিক্রি হতে না চাইলেই অপরাধী হয়ে যেতে হয়?
প্রশ্ন করা যায় হাজার কিন্তু উত্তর কে দেবে? কার কাছে পৌঁছাবো আমার এই প্রশ্নমালা নিয়ে? আইন তবে ক্ষমতার হাতে বন্দী? শ্যামল কান্তিদের রক্ষার কি কেউ নেই এই রাষ্ট্রে? একজন শ্যামল কান্তিকে হয়তো আপনারা জেলে ভরে নিজেদের ঝাল মিটাতে পেরেছেন কিন্তু সমাজে আজো যেসব শ্যামল কান্তিরা আছে তাদের ব্যাপারে আপনাদের সিদ্ধান্তটা কী?
শ্যামল কান্তির মাঝে আমি বাংলাদেশকে দেখি। কোর্টের বারান্দা দিয়ে পুলিশ যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো সেই হতভাগা মানুষটির চেহারা ছিল অবনত, বাকরুদ্ধ, কঠিন বেদনাহত। এটি কি সেই মানুষটিরই চেহারা? মিলিয়ে দেখুন- আপনার আমার প্রতিটা মানুষের একই চেহারা। জেলে কেবল শ্যামল কান্তি যায়নি, তার সাথী হয়েছে গোটা বাংলাদেশ। আজ এই শ্যামল বাংলার চোখে মুখে বেদনার ছাপ। চোখে ছল ছল করছে একটি বঙ্গোপসাগর। ভেতরের সুন্দরবন আজ মৃতপ্রায়। ক্লান্ত বাঘের মুখে কেবল গোমড়ানোর আওয়াজ আছে, নেই কোনও গর্জন।
শ্যামল কান্তিরা যদি জেলে যায় হেরে যায় বিবেক, শ্যামল কান্তিরা যদি মিথ্যার কাছে নিচু হয়, বিবেক বর্জিত হয় গোটা স্বদেশ। শ্যামল কান্তির পরিচয় একজন মুক্তিযোদ্ধা, তার পরিচয় একজন শিক্ষক, তার পরিচয় একজন সুনাগরিক। এই দেশের আইনের সুবিচার পাওয়ার অধিকার তারও আছে, এদেশের আবহাওয়ায় তারও সমান অধিকার আছে কারণ শ্যামল কান্তি সবকিছুকে ছাপিয়ে একজন মানুষ একজন বাংলাদেশি হতে চেয়েছিলেন। হয়তো এটাই তার অপরাধ। এই অপরাধ তাহলে ৩০ লাখ শহীদের। একজন শ্যামল কান্তিকে শাস্তি দিলে ৩০ লাখ শহীদকে আগে শাস্তি দিন, কেন তারা একটি শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক আর সুবিচারের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন?
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন