ষড়যন্ত্র রুখে দিতে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে: তারেক রহমান

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্তর্র্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, মাফিয়া সরকার বিনা ভোটে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার সময়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত করার অপকৌশলে লিপ্ত ছিল। ক্ষমতা হারিয়ে ৫ আগস্টের অপশক্তি এখনো আবার বিশ্বে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। পরাজিত অপশক্তির ষড়যন্ত্র রুখে দিতে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষের সব শক্তিকে সজাগ এবং সতর্ক থাকতে হবে।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, এই সরকারের মেয়াদ ৩ মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। একটি সরকারের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা মূল্যায়নের জন্য ৩ মাস যথেষ্ট সময় নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাজারে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রতিদিন জনগণকে হার মানতে হয়। ৩ মাস সময় তাদের (জনগণ) কাছে মনে হতে পারে ৩ বছরের সমান। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ও স্বল্প আয়ের মানুষের প্রতিদিনের দুঃখ-দুর্দশা লাগব করতে কঠোর হাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে ব্যর্থ হলে অন্তর্র্বর্তী সরকারের সব কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।

বুধবার বিকালে রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষ্যে আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় একটি ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে একটি বইও প্রকাশ করা হয়। দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হলে জাতীয়তাবাদী শক্তির বৃহৎ ঐক্যের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তারেক রহমান। সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাষ্ট্র মেরামত তথা প্রচলিত বিধিবিধান সংস্কারের জন্য অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার কার্যক্রম শুরু করেছে। সংস্কার একটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। যা এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় বিএনপি ও সমাজের বহু মানুষ উল্লেখ করেছেন। বিএনপি সংস্কারের পক্ষে, তবে রাষ্ট্রীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রথাগত সংস্কারের চেয়ে জনগণের রাজনীতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে গুণগত পরিবর্তন সংস্কার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় শেষ পর্যন্ত রাজনীতিকদের দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। বর্তমান সংবিধানে আছে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। সংবিধানে লেখা থাকার পরেও মাফিয়া সরকার মানেনি। গত ১৫ বছর জনগণের ভোট ছাড়াই, তথাকথিত জনপ্রতিনিধিকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে প্রকাশ্যে ফ্যাসিবাদের পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা গেছে। এজন্য জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, দেশে জনগণের আদালত এবং রাষ্ট্রীয় আদালত তথা বিচার বিভাগ শক্তিশালী ও স্বাধীন থাকলে ফ্যাসিবাদ কখনোই জনগণের স্বাধীনতা, ভোটের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না। জনগণের আদালত কিন্তু মব জাস্টিজ নয়, এর অর্থ কোনো ব্যক্তি কিংবা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান কিংবা ক্ষমতাহীন করার চূড়ান্ত ক্ষমতা জনগণের হাতে ন্যস্ত থাকা। রাষ্ট্রে রাজনীতিক বন্দোবস্ত এমন হওয়া প্রয়োজন যেখানে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ, যে পর্যায়ের প্রতিনিধি হোক না কেন, নাগরিকদের প্রত্যক্ষতা ছাড়া কোনোভাবেই একজন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক কর্মী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে সক্ষম হবেন না। এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে নিশিরাতের আয়োজন কিংবা ডামি প্রার্থী হিসাবে জনপ্রতিনিধি হওয়ার পথ স্বাভাবিকভাবে রুদ্ধ হয়ে যাবে।

তারেক রহমান বলেন, কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক কর্মী জনপ্রতিনিধি হতে চাইলে জনগণের বিশ্বাস এবং ভালোবাসা অর্জন করে ভোটের জন্য জনগণের কাছে যেতে হবে। প্রার্থীকে জনগণের আদালতে দ্বারস্থ হতে হবে। বিজয়ের জন্য জনগণের আদালতের রায় পেতে হবে। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রে জনগণের আদালত ও রাষ্ট্রীয় আদালত এই দুটি কার্যক্রম শক্তিশালী করা গেলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার নিশ্চিত করা যাবে। জনগণের ভোট প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা গেলে কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে নিষিদ্ধ কিংবা প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো অপ্রিয় কাজের দ্বায় রাষ্ট্রকে বহন করতে হবে না। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু করেছে। জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা জনগণের লুণ্ঠিত ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের যাত্রাপথের এটি একটি শুরু মাত্র। সংস্কার কার্যক্রম এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ধারাবাহিকতা যথানিয়মে নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হবে।

নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, জনগণের বিশ্বাস ভালোবাসা অর্জন করুন। জনগণের সঙ্গে থাকুন, সঙ্গে রাখুন। জনগণ পছন্দ করেন না এমন কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখুন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ৭ নভেম্বর শুধু একটি দিন নয়, দিবস নয়। ৭ নভেম্বর দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছিল। নতুন সত্তা পেয়েছিল। নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। সেই ইতিহাসের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ২৪-এর ৫ আগস্ট আরেকটি বিপ্লব ও অভ্যুত্থান ঘটেছে। পরাজিত করেছে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে (শেখ হাসিনা)। ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েছি। এখন ভবিষ্যতে সতর্কতার সঙ্গে পার হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার অতি অল্প সময়ে মধ্যে প্রয়োজনীর সংস্কার শেষে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করবে। জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে তারা সাহায্য করবে। নির্বাচন ইস্যুতে মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে। তিনি অতি দ্রুত সেই সংস্কারগুলো করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেবেন এবং জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন বলে প্রত্যাশা করি।

স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় আমরা রাজপথে ছিলাম, আছি। আমরা মাঠ ছাড়িনি। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে আবার সেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের সম্মুখীন হয়েছি। গণতন্ত্রের পথে যে লক্ষ্য তার সম্মুখীন হয়েছি। যুগপৎ আন্দোলনের দলগুলোকে নিয়ে তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনকে আবারও সফল করতে হবে। নতুন করে আর বয়ান শুনতে চাই না। আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে চাই। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, শক্তিশালী সমাজ বিনির্মাণের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের কথা বলছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যাবে। সেই সংস্কারকে বর্তমান সরকারের কাছে যদি হয় একমাত্র কর্তব্য তাহলে ভুল হবে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার চাইলে মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সরকার এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়নি। নির্বাচন কমিশন গঠন করেনি। নির্বাচিত সরকারই পারে সংবিধান সংশোধন করতে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে এবং প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্যে দেন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস, অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল আহসান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় নেতা আহমেদ আযম খান, আবদুস সালাম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, উত্তরের আমিনুল হক, যুবদলের আব্দুল মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানী, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব প্রমুখ। এছাড়া সভায় বিএনপি এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।