সংবিধানসম্মত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দেবে ঐক্যফ্রন্ট!
বর্তমান সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপির তৈরি ‘সহায়ক সরকারের রূপরেখা’কে সামনে রেখে এই প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। সোমবার (৫ নভেম্বর) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠকে এই রূপরেখা চূড়ান্ত হতে পারে। রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে তার মাধ্যমেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, তিনটি মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ, টেকনোক্র্যাট কোটায় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাব থাকতে পারে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্বল্প পরিসরে আলোচনা করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট। রবিবার (৪ নভেম্বর) চিঠি প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা আওয়ামী লীগের দফতরে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
ফ্রন্ট সূত্র বলছে, সময় দিলেই নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে তোলা হবে। এক্ষেত্রে তিনি সময় না দিলে পরবর্তী সময়ে এই প্রস্তাব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। এরআগে রবিবার অথবা সোমবার পছন্দের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করবে ঐক্যফ্রন্ট।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্ভাব্য রূপরেখায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অন্তত চারটি বিষয়ে আলোচনা করবে। তবে ‘আলোচনায় কোনও সাফল্য আসবে না’—এমন ধারণা নিয়ে এই প্রস্তাবগুলো প্রধানমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরবেন ফ্রন্টের নেতারা। সময় নির্ধারিত হলে সম্ভাব্য এই দ্বিতীয় দফার সংলাপে আইনজীবী শাহদীন মালিক, আসিফ নজরুল ও বোরহান উদ্দিনকে প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত করবে ঐক্যফ্রন্ট।
ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলছেন, প্রথম সংবিধানের ভেতরে থেকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থাকলেও তার ক্ষমতা সংকুচিত রাখা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে অন্য নিরপেক্ষ একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হবে। আর এরই মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচন পেছানোর দাবির নেপথ্যে এই কারণটিই অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংসদ ভেঙে নির্বাচন দেওয়ার যে দাবি করেছে, তাতে করে ঐক্যফ্রন্টের চাওয়া দশম সংসদের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর নির্বাচন আয়োজন করতে। সেক্ষেত্রে সংসদ বহাল রেখে মেয়াদ শেষ হওয়ার নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন করার যে বাধ্যবাধকতা আছে, সেটি আর থাকবে না।
সংবিধানের ১২৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘(৩) সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোনও কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নববই দিনের মধ্যে:
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সংবিধানের ১২৩ ধারা ৩-উপধারার খ-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন, ‘২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ আছে। সরকার যদি সেকেন্ড পজিশন অ্যাপ্লাই করে, তাহলে অটোমেটিক সংসদ থাকে না। এতে করে ঐক্যফ্রন্টের দাবি মানা হয়ে যায়।’
কীভাবে তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হবে, এমন প্রশ্নে খন্দকার মাহবুব হোসেন ব্যাখ্যা করেন, ‘সংসদ ভেঙে গেলে রাষ্ট্রপতি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার করবেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করবেন যেন তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালান। তখন প্রধানমন্ত্রী তো সেই সরকার গঠন করবেন, সেখানে নিশ্চয়ই মন্ত্রী থাকবেন। সে মন্ত্রিসভায় বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী ওয়ান-টেনথ টেকনোক্র্যাট হিসেবে থাকতে পারবে। এখন বিএনপি সংসদে না থাকলেও সমস্যা হবে না। ইচ্ছে করলে সেটা তিনি করতে পারবেন। তখন প্রধানমন্ত্রী চাইলে, তার ক্ষমতা কমিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নির্দলীয় কোনও ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিতে পারেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাচর্চা করবেন না। নির্দলীয় একজন ব্যক্তিকে সরকারের প্রধান করবেন। তখন আর নির্বাচনের ব্যাপারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কোনও রুল থাকবে না। এর ফলে একদিকে যেমন সংসদ ভেঙে যাবে, অন্যদিকে তিনি ক্ষমতায়ও থাকতে পারেন। এই একটি ফর্মুলা হতে পারে এবং সেটা বর্তমান সংবিধানের ভেতরে থেকেই করা যায়।’ শেষ দিকে এসে খন্দকার মাহবুব হোসেন যুক্ত করেন, ‘এটা আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘ আমরা সংলাপের সময় পেলে সাতদফার সাংবিধানিক ও আইনগত দিকগুলো তুলে ধরবো।’ এক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তির নাম ফ্রন্ট প্রস্তাব করবে কিনা, এমন প্রশ্নে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘এটা তো বসার ওপর নির্ভর করবে। আগে তো সম্মতি দিক, এরপর সবাই মিলে লোক বের করা যাবে।’
ফ্রন্টের সূত্রগুলো বলছে, ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ-ঐক্যফ্রন্ট সংলাপে সংসদ ভেঙে দিলে কীভাবে দেশ চলবে, কার নেতৃত্বে চলবে—এমন বিষয় নিয়ে আলোচনা ছিলো। ওই সংলাপেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রস্তাব ছিল, ‘আসুন আমরা একটা কমিটি করে দেই। সেই কমিটিই বের করুক সাংবিধানিক পথ।’
শনিবার রাতে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সাতদফা নিয়ে সাংবিধানিক ও আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা করা হবে। এজন্য আমরা শাহদীন মালিক, আসিফ নজরুল ও বোরহান উদ্দিনকে যুক্ত করেছি। তারাও সংলাপে যেতে পারেন, যদি সময় পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে সংবিধানসম্মত উপায় তারা বের করবেন।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতা জানান, রবিবার ও সোমবার ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ক কমিটি ও স্টিয়ারিং কমিটি বৈঠক করবে। এর একটি বৈঠক হবে কামাল হোসেনের চেম্বারে। সেখানেই আইনজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে পথ বের করবেন তারা।
ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও সাবেক ডাকসুর ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর বলেন, ৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬ টায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের মতিঝিলের অফিসে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বৈঠক হবে। আর আগামীকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীকে সংলাপের চিঠি পাঠানো হবে।
ফ্রন্টের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি—এ তিনটি পদ মাথায় রেখে বিকল্প প্রস্তাবও তৈরি রাখা হবে।
নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির প্রস্তুতি গত কয়েক বছরের। বিশেষ করে দলটি প্রথমে ততত্ত্বাবধায়ক সরকার, পরবর্তী সময়ে সহায়ক সরকারের নাম উচ্চারিত হয় দলটির নেতাদের কণ্ঠে। এখন দলটির দাবি—নিদর্লীয়, নিরপেক্ষ সরকার। নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ করার দাবিতে ২০১৭ সালেও রাজনৈতিক দলগুলো বিভক্ত ছিল। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপে অংশ নিয়ে দলগুলো দ্বিধাবভক্ত প্রস্তাব দেয়।
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠনে যে সংলাপ হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর, সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার চায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, বিজেপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বিকল্প ধারা, গণফোরাম, জেএসডি, গণফ্রন্ট। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন চেয়েছিল। আওয়ামী লীগের বাইরে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে জাসদ ইনু, জাসদ আম্বিয়া, তরিকত ফেডারেশন, ওয়াকার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল ও জেপি সাংবিধানিক নিয়মেই নির্বাচন অনুষ্ঠান চেয়েছিল সেই সংলাপে। এর বাইরে ওই সংলাপে বামপন্থী সিপিবি বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন চেয়েছিল। দলটির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নির্বাচনকালীন সময়ে সরকারের কর্তৃত্বকে সাংবিধানিকভাবে সংকুচিত করে তার অন্তর্বর্তীকালীন কাজ তত্ত্বাবধায়নমূলক অত্যাবশ্যক রুটিন কিছু কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। প্রয়োজনে সংবিধানও সংশোধন চায় সিপিবি। শুক্রবার (২ নভেম্বর) গণভবনের সংলাপে গিয়ে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টও শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন করার সম্মতি জানিয়ে এসেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রস্তাবের পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয় নিরপেক্ষদের হাতে দেওয়ার প্রস্তাব করবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তিনটি মন্ত্রণালয় হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়। সাতদফার মধ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের বিষয়টিও আছে। এই ক্ষেত্রে ফ্রন্টের পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ একজনের নাম প্রস্তাব করা হতে পারে। প্রাথমিক আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক একজন চেয়ারম্যানের নাম এসেছে আলোচনায়।
বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা জানান, যদি এই তিনটি মন্ত্রণালয় সরকার ছাড়তে না চায়, তাহলে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ থেকেই নতুন তিনজনকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবের চিন্তা চলছে।
ফ্রন্টের অন্যতম নেতা সুব্রত চৌধুরী এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তার ভাষ্য, ‘আমরা সবিস্তারে আরও পরে বলতে পারবো, সিদ্ধান্তের পর।’
বিএনপির দায়িত্বশীলসূত্র বলছে, সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার ওপর আস্থার ঘাটতি থাকাতেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে বিকল্প কাউকে চাওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বয়ং বা স্পিকার হলেও সমস্যা থাকবে না। যদিও বর্তমান দশম সংসদই এই দুটি পদে নিয়োগ দিয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, গত ত্রিশ বছর ধরেই তো দুটো দল পরস্পরকে নির্যাতন করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির সময়ে যে নিপীড়ন বা নির্যাতনের কথা বলছেন, একইসঙ্গে বিএনপির নেতাদের ওপরই হয়েছে। এমনকী বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকেও জেলে রাখা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই। বিএনপির নেতারা প্রকাশ্যেই এ বিষয়টি বলে এসেছেন। ফলে, বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব চায় বিগত দিনের কথা পুনরাবৃত্তি না করে সমাধানের দিকে যেতে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। এই লেভেল প্লেয়িং নিশ্চিত করতে কয়েকটি বিষয়কে তো আমলে নিতেই হবে সরকার। এক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্ট যে সাত দফা দাবি দিয়েছে, এটা মেনে নিতে হবে সরকারকে।’
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন