সন্দেহ অবিশ্বাস বিএনপিতে

মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সারা দেশেই বাড়ছে দলটির গৃহদাহ। দল পুনর্গঠন ও চলমান স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে দলীয় বিবাদ প্রকাশ্যে চলে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশ সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন করছেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতারা। তাদের অনেকে এলাকায় গিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনে গোপনে উসকে দিচ্ছেন স্থানীয় নেতাদের। ঢাকায় ফিরে তারাই আবার দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘনের দায়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বহিষ্কারের মাধ্যমে নিজেদের পথ প্রশস্ত করছেন। এতে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে।

দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবরের দলীয় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে কারাগারে যাওয়া নেতাদের অনেকের ভূমিকা রহস্যজনক বলে মনে করছেন দলীয় অনেকে। এ নিয়ে দলের ভিতরে রয়েছে বিতর্ক। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের (অডিও-ভিডিও) ভিত্তিতে বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে।

অনেককে অঘোষিতভাবে ‘ওএসডি’ করা হয়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। এ নিয়ে ক্ষোভে কেউ কেউ রাজনীতি থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। চলে যাচ্ছেন দেশ ছেড়ে। এসব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপি মহাসাগরের মতো বিস্তৃত একটি বিশাল রাজনৈতিক দল। এ দলে নেতাদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতামত প্রদানের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতেই পারে। তবে কোনো রকমের অভ্যন্তরীণ বিরোধ বা কোন্দল নেই। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে কত চেষ্টা করেছে এই সরকার, কিন্তু কাউকে দলচ্যুত করতে পারেনি।

জানা গেছে, সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি বিরোধ-কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে চলমান উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এই নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে বয়কটের পক্ষে নেতা-কর্মীদের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সারা দেশে সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকদের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ নেতাই তাদের নিজ নিজ এলাকায় সেই দায়িত্ব পালন করেননি। অনেকে এলাকাতেই যাননি।

জেলা বিএনপির শীর্ষকর্তারাও তেমন কোনো ভূমিকা রাখেননি। বরং উল্লিখিত নেতাদের এলাকাতেই ভোট কেন্দ্রে সবচেয়ে বেশি ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে। নির্বাহী কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব নেতার দ্বৈত ভূমিকায় তৃণমূলের নেতারা ক্ষুব্ধ। কেন্দ্র থেকে দায়িত্ব দেওয়ার পর আশানুরূপ ফল না পেয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে সরাসরি ফোনে কথা বলা শুরু করেছেন। যারা কথা শুনছেন না, তাদেরকে দলের সব রকমের পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।

তারপরও উপজেলা তথা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ ঠেকানো যাচ্ছে না স্থানীয় বিএনপি নেতাদের। এর পেছনে কেন্দ্রীয় অনেক নেতার ইন্ধন আছে বলেও অভিযোগ করেন বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মী। অন্যদিকে, এলাকায় আধিপত্য ধরে রাখতে নিজের অনুসারীদের যে কোনো মূল্যে নেতৃত্বে আনতে মরিয়া কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। তদবির আর অনৈতিক উপায়ে সুবিধাবাদীরা চলে আসছেন জেলা ও মহানগরীর শীর্ষ নেতৃত্বে। বাদ পড়ছেন যোগ্য ও ত্যাগীরা। পুনর্গঠনের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে ভবিষ্যতে এ কোন্দল আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে, যা আগামী দিনে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন নেতা-কর্মীরা।

সারা দেশের জেলা কমিটি গঠন নিয়ে বিএনপিতে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কোনো কমিটিই পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে না। কাউন্সিলও হচ্ছে না বেশির ভাগ জেলায়। বাড়ছে অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও কোন্দল। নেতা-কর্মীরা বলছেন, কমিটি গঠন নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আন্তরিক কিংবা কঠোর হয়েও ফল পাচ্ছেন না। দলের প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের সৃষ্ট কোন্দলের কারণে সময়মতো কমিটি গঠন সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ঘিরে বিএনপির কেন্দ্র ও তৃণমূলের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব দুটিই বেড়ে চলেছে।

মাঠের নেতাদের নির্বাচন থেকে ফেরানো নিয়ে দলে বেশ অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। তিন ধাপের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে অংশগ্রহণের দায়ে ইতোমধ্যে দুই শতাধিক স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।  এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তিন দফার ভোটে অংশ নেওয়া বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে শোকজসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো ‘ডামি’ নির্বাচনে অংশ নেবে না বিএনপি। এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। এই সরকারের আমলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে- এ কথা দেশে-বিদেশে কোনো মহলই আর বিশ্বাস করে না।