সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন দেশটা গড়তে হবে : সনাতনী সমাবেশে নেতারা

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বিএনপি ও দলপন্থি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে লড়াই করেছে। সুতরাং কারও অবদানকে ছোট বা খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। স্বৈরাচারের পতনের পর রাষ্ট্রকে এখন নতুন করে বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে। এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশকে গড়তে হবে। কেউ যেন কোনো ষড়যন্ত্র করতে না পারে, জাতীয় স্বার্থে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমরা চাই, সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে সম্প্রীতি বজায় থাকুক।’

শুক্রবার (৮ আগস্ট) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সনাতনী সমাবেশ-২০২৫-এ তারা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন ফ্রন্ট এই সনাতনী সমাবেশের আয়োজন করে। এই সমাবেশে সংগঠনের সারা দেশের ৫৫টি জেলার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পতন হলেও এখনো আওয়ামী লীগ বা ভারতের জন্য বাংলাদেশে দাঙ্গা হতে পারে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক মোড়টা ঘুরিয়ে নির্বাচনটা বানচাল হতে পারে। সেজন্য জাতীয় স্বার্থে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’

সনাতনী জনগোষ্ঠীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা একত্রিত থাকেন। ষড়যন্ত্র দেশে আছে, রাষ্ট্রীয় আছে, গণতন্ত্র নিয়েও আছে। আপনারা যারা সামনে আছেন, অনেক সময় ক্লান্ত হয়ে ফেরত যেতে পারেন, কিন্তু ফেরত যাবেন না। মাথা সোজা করে দাঁড়াবেন। আমি যত দূরেই থাকি, মাঠে আছি। আমি আপনাদের দেখব। জাতীয়তাবাদী শক্তি কখনো মাথা নোয়ায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে মুসলমান নয়, হিন্দুরাই হিন্দুদের শত্রু। হিন্দুরাই হিন্দুদের ক্ষতি করে। এক ভাই চলে যায়, তিন ভাইয়ের জায়গা লিখে দিয়ে যায়। আমি মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করি। হিন্দু-মুসলিমের ব্যবধান বুঝি না। আমি খারাপ লোক, ভালো লোকের ব্যবধান বুঝি; সৎ লোক এবং প্রতারকের ব্যবধান বুঝি। সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করি না। হিন্দু-মুসলমান সব এক; কারণ, ছুরি দিয়ে আঘাত করলে দেখা যাবে সবার রক্তই লাল, কারও রক্ত আলাদা নয়।’

অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘শেখ হাসিনা নিজেকে সামাল দিতে পারছেন না। পার্শ্ববর্তী দেশে বসে যখন তখন উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। বিবিসির প্রতিবেদনে দেখলাম, কলকাতায় অফিস খুলে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন শেখ হাসিনা। পালানোর পরেও তার ষড়যন্ত্র থামছে না। মাস্টারমাইন্ড হয়ে ভারতে থেকে তিনি দেশকে অস্থির করার চেষ্টা করছেন।’

তিনি বলেন, ‘ভারত শেখ হাসিনাকে জায়গা দেয়। অন্যদিকে ভারতে বাংলা ভাষাভাষী মুসলিমরা টিকতে পারছে না। তাদের বাংলাদেশে পুশইন করছে। তাহলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে না কেন, সেখানে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুশব্যাক করে না কেন? বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে সেখান থেকে বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা করা হচ্ছে কি না, দেশবাসীর মনে আজ সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। একজন মেজর ধরা পড়ছে, সে আওয়ামী লীগের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবে। এই রকম নাকি আরও আছে। এই ঘটনাগুলো কীসের? কলকাতায় কার্যালয় আর বাংলাদেশের ভেতরের এ সব ঘটনার মধ্যে যে কোনো যোগসূত্র নেই, তা বলা যাবে না।’

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারের পতনের পর বাংলাদেশকে নতুন করে বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফার আলোকে আগামীতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি গণতান্ত্রিক-মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক ও বিএফইউজের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ‘একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আমরা সবাই একসঙ্গে লড়াই করেছি। আমরা চাই, সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে সম্প্রীতি বজায় থাকুক। আমরা চাই, সনাতনীদের ওপর হওয়া অপকর্মের ঘটনাগুলোর বিচার হোক। প্রতিটি ধর্মীয় সংখ্যালঘু হত্যাকাণ্ড, হামলা-নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি থাকবে, এসব ঘটনার বিচার করতে হবে। এই সরকার বিচার না করলে আগামী দিনে জনগণের ভোটে বিএনপি বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে, সে সময় যেন এসব হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন-নিপীড়নের বিচার হয়।’

জাতীয় হিন্দু মহাজোটের (একাংশ) মহাসচিব অ্যাড. গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক বলেন, ‘সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায় বিএনপির দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। কারণ, বিএনপি অসাম্প্রদায়িক দল। আশা করব, বিএনপি আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করবে।’

সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়নবিষয়ক সহ-সম্পাদক ও বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন ফ্রন্টের সভাপতি অপর্ণা রায় দাস বলেন, ‘বিএনপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেনি, হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করেনি, আগামীতেও করবে না। বিএনপি মন্দির গড়ে, ভাঙে না; লুটপাট করে না।’

তিনি বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর মন্দির কেন পাহারা দিতে হয়েছিল? কারণ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মন্দিরে গিয়ে লুটপাট করে, প্রতিমা ভাঙচুর করে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। আমাদের বিএনপির পক্ষে, ধানের শীষের পক্ষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।’

বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক সমীর কুমার বসু এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জয়দেব রায়ের যৌথ সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন- বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরফত আলী সপু, রফিকুল ইসলাম জামাল, আসাদুল করিম শাহীন, অমলেন্দু দাস অপু, দেবাশীষ রায় মধু, সিনিয়র সাংবাদিক আমিরুল ইসলাম কাগজী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের স্ত্রী হাসনা মওদুদ, পূজা উদ্‌যাপন ফ্রন্টের সুরঞ্জন ঘোষ, গৌতম মিত্র, গৌরাঙ্গ বোস, মানিক লাল ঘোষ, সুভাষ চন্দ্র দাস, গোবিন্দ চাঁদ কুণ্ড, রাজীব ধর তমাল, ঢাকা মহানগরের বিশ্বজিৎ ভদ্র প্রমুখ।

পূজা ফ্রন্টের জেলা প্রতিনিধিদের মধ্যে খুলনা জেলার আহ্বায়ক নিত্যানন্দ মণ্ডল, সাতক্ষীরা জেলার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট অসীম মণ্ডল, নড়াইল জেলার সদস্য সচিব কার্তিক দাস, মাগুরা জেলার সদস্য সচিব মিহির কান্তি বিশ্বাস, ঝিনাইদহ জেলার সদস্যসচিব সমীর হালদার, ফরিদপুর জেলার আহ্বায়ক অজয় কর, কুড়িগ্রাম জেলার সদস্যসচিব স্বপন সাহা, ময়মনসিংহ মহানগরের আহ্বায়ক পার্থ সারথি সিনহা, কুমিল্লা মহানগরের আহ্বায়ক শ্যামল কৃষ্ণ সাহা, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক সুভাষ বণিক, শেরপুর জেলার আহ্বায়ক শুভ্র দাস, পিরোজপুর জেলার আহ্বায়ক অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার মিস্ত্রি, গোপালগঞ্জ জেলার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক রমেন্দ্র নাথ সরকার, মাদারীপুর জেলার আহ্বায়ক জীবন বোস প্রমুখ বক্তব্য দেন।