সমুদ্রে ভাসছে মরদেহ, ধ্বংসস্তূপে জীবনের আর্তনাদ

ভূমিকম্প আর সুনামিতে বিধ্বস্ত ইন্দোনেশিয়ায় মৃত্যু আর জীবন যেন পরস্পরের হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। লাশ ভাসছে সমুদ্রের পানিতে, অথবা পড়ে রয়েছে উপকূলে। রাস্তার পাশে ঢেকে রাখা হয়েছে সারি সারি মরদেহ। এর একাংশ থেকে কাপড় সরে আলগা হয়ে গেছে। আবার জীবনের আর্তিও সেখান থেকে খুব দূরে নয়। মরদেহের অদূরেই কোনও ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসছে মানুষের কান্না। তবে জীবনের এই আর্তনাদে সাড়া দিতে বেগ পেতে হচ্ছে উদ্ধারকারীদের। বিদ্যুতহীনতা আর রাস্তাঘাট চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ার পাশাপাশি রয়েছে ভারি যন্ত্রপাতির অভাব। কর্তৃপক্ষ এরইমধ্যে ৮ শতাধিক মৃত্যুর পাশাপাশি ৫ শতাধিক মানুষের আহত হওয়ার খবর দিয়েছে। তবে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংগঠন রেডক্রস বলছে, ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত খুব সামান্যই জানা গেছে। এমনও দুর্গত অঞ্চল রয়েছে, যেখানে এখনও পৌঁছানোই যায়নি।

২৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার সুলাবেসি দ্বীপে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। সেখানে কম্পনের পর আছড়ে পড়ে প্রলয়ঙ্করী সুনামির ঢেউ। সুউচ্চ ঢেউ লণ্ডভণ্ড করে দেয় উপকূলীয় এলাকা। শুক্রবারের কম্পন ও সুনামির পর শনিবার উপকূলে সন্ধান মিলেছে বহু মরদেহের। ইন্দোনেশীয় কর্তৃপক্ষকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, ৮৩২ জনের নিহত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তরফে এর মুখপাত্র সুতোপো পুরও নুগরোহো জানিয়েছেন, এখনও অনেক মরদেহ উদ্ধার করা যায়নি।

সুলাবেসি দ্বীপের প্রাদেশিক রাজধানী পালু শহরে ৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। ভূমিকম্পের পর সেখানকার চিত্র এখন ভয়াবহ। উপকূলীয় এলাকায় আংশিকভাবে ঢাকা পড়া মৃতদেহ পড়ে আছে। ছাদ, কাঠসহ বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে বেঁচে যাওয়াদের উদ্ধার করা হচ্ছে। এক ব্যক্তিকে দেখা গেছে, এক ছোট শিশুর মাটিমাখা মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছেন। নাইনিং নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা কম্পাস.কম-কে বলেন, ‘সাগরতীরে অনেক মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং সাগরপৃষ্ঠেও মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে।’

দিন গড়িয়ে রাত নেমে আসলেও শক্তিশালী আফটারশকের আতঙ্কে স্থানীয়দের অনেকে তাদের বাড়িতে ফিরে যান না। অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে রাত কাটাচ্ছেন তারা। তাদের আশঙ্কা, বাড়িতে ফিরে গেলে শক্তিশালী আফটারশকে তাকের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি ভেঙে পড়তে পারে। পালু শহরের তথ্য সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পেজ এখন নিখোঁজদের তথ্য জানানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে। স্বজনরা নিখোঁজ সন্তান, স্ত্রী, মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানির ছবি পোস্ট করে তাদের সন্ধান চাইছেন।

ভূমিকম্পের সময় মেরুদণ্ডে ও ঘাড়ে আঘাত পেয়েছেন ডোয়ি হারিস। পালুর আর্মি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। ভূমিকম্পের পর আফটারশক চলতে থাকায় রোগীদেরকে হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ভূমিকম্পের সময়কার কথা বলতে গিয়ে হারিসের দুই চোখ কান্নায় ভরে ওঠে। তিনি জানান, ভূমিকম্পের সময় তিনি স্ত্রী ও মেয়েসহ হোটেলের ছয়তলার একটি কক্ষে অবস্থান করছিলেন। হারিস বলেন, ‘নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য আমাদের হাতে কোনও সময় ছিল না। আমি মনে হয় একটি দেয়ালের ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়েছিলাম।’ হারিস জানান, একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তার পরিবার পালু শহরে গিয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ‘আমি শুনতে পেলাম আমার স্ত্রী বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে, কিন্তু পরে ও নীরব হয়ে গেলো। আমি জানি না ও আর আমার সন্তান কেমন আছে। আশা করি তারা নিরাপদ আছে।’

নগরীর রোয়া-রোয়া হোটেলের ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়েছেন ২৪ জন। হোটেলের মালিক স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে কান্নার আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। তবে তাদের উদ্ধারের জন্য প্রয়োজনীয় ভারি যন্ত্রপাতি পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্ধারকারীরা নিজেদের শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেই উপজীব্য করেছেন জীবন বাঁচানোর। হাত দিয়ে তারা ধ্বংসস্থূপ সরিয়ে ওই ২৪ জনকে উদ্ধারের প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পালুর আরেক বাসিন্দা ৩৯ বছর বয়সী আনসার বাচমিদ ভূমিকম্পের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম এবং ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। এখানকার মানুষের খাদ্য, পানীয়, বিশুদ্ধ পানিসহ সহায়তার প্রয়োজন।’

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ-এর জাকার্তাভিত্তিক কর্মকর্তা জ্যান গেলফান্ড বলেন, ‘এটি ভয়াবহরকমের দ্বৈত দুর্যোগ। ইন্দোনেশীয় রেড ক্রস জীবিতদের উদ্ধারে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উদ্ধারকারীরা, তবে তারা সেখানে কী পাবে আমাদের জানা নেই।’ রেডক্রসের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘পালু শহরের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে আমরা এখন সীমিত আকারে জানতে পারছি। তবে ডংগালার কোনও খোঁজখবর আমরা পাচ্ছি না, এটা খুব উদ্বেগের। সেখানে তিন লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস। এ দুর্যোগ এরইমধ্যে ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছে, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াহ হতে পারে।’

ভূমিকম্প ও সুনামিতে ক্ষতিগ্রস্ত আরেক শহর ডংগালা নিয়ে উদ্ধারকারীদের মধ্যে আলাদা করে উদ্বেগ রয়েছে। কারণ সেখানকার ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এখনও নিরূপণ করা যায়নি। সহায়তা সংস্থা ক্যাথলিক রিলিফ সার্ভিসেস-এর ইন্দোনেশিয়ার কান্ট্রি ম্যানেজার ইয়েনি সুরিযানি বলেন, সড়কপথ কিংবা আকাশপথ কোনওভাবেই ডংগালায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। সেক্ষেত্রে সমুদ্রপথে সহায়তা নিয়ে যাওয়া লাগতে পারে। ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের ইন্দোনেশিয়া প্রধান জ্যান গেলফান্ড মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন- কে বলেন, ‘শুধু বড় বড় শহরের বাসিন্দাদের বিষয় নয় এটি। দুর্গম এলাকায়ও অনেক মানুষ বাস করে, যাদের কাছে পৌঁছানো খুব কঠিন।‘’

জাতিসংঘ ছাড়াও মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ইন্দোনেশিয়ায় সহায়তা পাঠাতে চেয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতায় সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত তার সংস্থা। অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন রবিবার বলেছেন, ‘যদি তার (উইদোদো) আমাদের সহায়তার প্রয়োজন হয়, তিনি তা পাবেন।’ পালু ও ডংগালা শহর এখনও বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন, জ্বালানি সরবরাহ সেখানে কমে আসছে। কয়েকটি ত্রাণবাহী বিমান পালুর প্রধান বিমানবন্দরে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও কর্মকর্তারা জানিয়ে দিয়েছেন, কয়েকদিন সেখানে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকবে। রেড ক্রসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ১৬ লাখ মানুষের ওপর এই ভূমিকম্প ও শুনানির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে।