‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ দেননি, তাহলে বিজ্ঞাপনটা দিলো কে?
জঙ্গি সনাক্তে ২৩টি লক্ষণের বিজ্ঞাপন জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে দেয় ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের সংগঠন, যার আহ্বায়ক অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এতে হঠাৎ দাড়ি রাখা, টুপি পরা, টাখনুর উপরে কাপড় পরাসহ মুসলিমদের প্রাত্যহিক জীবনে পালন করা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে জঙ্গিবাদের বৈশিষ্ট হিসেবে তুলে ধরা হয়।
একই সঙ্গে এসব লক্ষণ কারও মধ্যে পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তার সম্পর্কে জানাতে নাগরিকের প্রতি আহ্বানও জানায় সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
গত ১২ মে জাতীয় অন্তত ৮টি জাতীয় দৈনিকে প্রথম/শেষ পাতায় ঢাউস ওই বিজ্ঞাপন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও ইসলামপন্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রেফতার ও ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার বাদ জুমা রাজধানীর বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট।
ইসলামপন্থী দলটি সারা দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকেও বাদ জুমা বিক্ষোভ মিছিল করারও আহ্বান জানিয়েছে।
এমন প্রতিবাদের মুখে বৃহস্পতিবার (১৬ মে) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, তারা এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন কোনো জাতীয় দৈনিকে দেননি।
মুসলিমদের উস্কে দিয়ে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ নষ্টের চক্রান্ত হিসেবে এই বিজ্ঞাপনকে অভিহিত করেন তিনি।
তবে দৈনিক সমকাল, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দেশ রূপান্তরসহ যেসব দৈনিকে বিজ্ঞাপন এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিবেন কিনা- এমন প্রশ্নে সংবাদ সম্মেলনে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অবশ্য এই অভিনেতা দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন অপপ্রচার চালিয়েছে। গত ১২ মে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত বিজ্ঞাপনটির সঙ্গে কোনো পর্যায়েই সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল), রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার, সাবেক সংস্কৃতি ও তথ্যসচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী ঐক্যজোট চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী, খ্রিস্টান অ্যাসোয়িশনের সভাপতি উইলিয়াম প্রলয় সমাদ্দার, দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আলী হাবিব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অবস্থান স্পষ্ট করতে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়দের এমন চেপে যাওয়ার চেষ্টায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিনেতা পীযূষ কী চাপের মুখে অবস্থান থেকে সরে আসছেন? আর সত্যিই যদি তিনি এবং তার সংগঠন এমন ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন না দিয়ে থাকেন, তাহলে কে বা কারা দিলো?
বিজ্ঞাপন প্রকাশ হয়েছে এমন একাধিক জাতীয় দৈনিকের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও ‘রহস্যজনক’ জবাব মিলেছে। অফ দ্য রেকর্ড তাদের ভাষ্য এমন, বাংলাদেশে কোন পত্রিকা আছে, যারা প্রথম ও শেষ পাতার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অর্থ ছাড়া ছেড়ে দেবে?
পত্রিকাগুলোর বিজ্ঞাপন বিভাগে যোগাযোগ করা হলে, কারা, কত টাকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, সব তথ্য থাকলেও তা ‘আপাতত’ দিতে রাজি হননি।
১২ মে দৈনিক সমকালে ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র ব্যানারে ‘জঙ্গি শনাক্তকরণ’ বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটিই বৃহস্পতিবার আরেকটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে যে, ওইদিনের বিজ্ঞাপন সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র নয়। এটা মিথ্যা।
দুটি বিজ্ঞাপনের বিষয়ে সমকালের এক বিজ্ঞাপন নির্বাহীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে শুরুতে তিনি বলেন, ‘আমরা গত ১২ মে এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন দেইনি। বিভিন্ন পত্রিকায় আসা বিজ্ঞাপন মিথ্যা বলে সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র পরেরটি আমরা প্রকাশ করেছি বিজ্ঞাপন হিসেবে।’
পরে তাকে ১২ মে সমকাল পত্রিকার কপি দেখালে বলেন, ‘অনেকগুলো পত্রিকা দিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমাদেরও দেয়া হয়েছে মনে হয়।’
এই নির্বাহী আরও দাবি করেন, ‘আজকের বিজ্ঞাপনটি সঠিক। এখানে সম্প্রীতি বাংলাদেশ’র আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের নাম রয়েছে। যেটি আগেরটিতে ছিল না। কেউ বিজ্ঞাপন দিলে আমরা ছেপে থাকি। কিন্তু, সেটি কারা দিয়েছিল, এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হবে না।’
গত ১২ মে একই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক দেশ রূপান্তরে। পত্রিকাটির বিজ্ঞাপন বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সেটিকে বিজ্ঞাপন বলা যাবে না। নিউজ ছিল। বিস্তারিত জানতে হলে নিউজ বিভাগে যোগাযোগ করতে হবে।’
এমন প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বড় বড় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এলো। বিজ্ঞাপনদাতারা এখন তা বেমালুম অস্বীকার করছেন। আবার পত্রিকাও বিজ্ঞাপনের তথ্য স্পষ্ট করছে না। জঙ্গিবাদের মতো এমন স্পর্শকাতর ইস্যুতে সবপক্ষের এমন অবস্থান রহস্যে ঘেরা। অবশ্যই সরকারিভাবে এর তদন্ত হওয়া দরকার।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘বিজ্ঞাপনটা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়রা না দিলে কে দিয়েছেন, সেটি তদন্ত করে দেখা দরকার। আর একটা কথা হলো, জঙ্গিবাদের বিষয়ে সবারই একটু সতর্ক হয়ে আলাপ করা উচিত। কারণ, লোকজন যখন জঙ্গিবাদ নিয়ে আলাপ করে, তারা অনেক বেশি রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীর সদস্যরাই যে শুধু জঙ্গি কার্যক্রম চালায় এমন কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই। অনেকের ধারণা ছিল, মাদ্রাসার লোকেরা জঙ্গিবাদে জড়ায়। কিন্তু, এটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তেমনি ঢালাওভাবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছেলেরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে, বলাও উচিত নয়।’
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া, মসজিদে যাওয়া বা নামায পড়া মানেই যে জঙ্গিবাদে যুক্ত হওয়া এটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। এই ধারণা মুসলিমদের ওপর আমেরিকানদের চাপিয়ে দেয়া। হঠাৎ একজন মানুষ মসজিদে যাচ্ছে বলে সে জঙ্গি! এমন অসংখ্য লোককে আমি জানি যারা হঠাৎ করে ধর্মের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু, তারা কেউই জঙ্গিবাদে জড়িত নন। এজন্য একটু দায়িত্ব নিয়েই এমন বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা দরকার ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আরেকটা বিষয় দেখা উচিত, তারা যে কাজ করছেন এতে কোনো দাতা সংস্থার অর্থ আছে কিনা? অথবা কারা উনাদের উপদেশ দিচ্ছেন? কারণ, তারাতো জঙ্গিবাদ বিশেষজ্ঞ নন, তাহলে তারা এই সংশ্লিষ্ট ভাষা বা ব্যাখ্যাগুলো কোথা থেকে পেলেন?’
আফসান চৌধুরী আরও বলেন, ‘হয়তো বিজ্ঞাপন দেয়ার পর তাদের ওপর কোনো চাপ এসেছে, যে এভাবে বিজ্ঞাপন দেয়া ঠিক হয়নি; এভাবে জঙ্গি চিহ্নিত করা যায় না। আমার মনে হয়, কোনো সংস্থা এখানে জড়িত। তারাই সম্প্রীতি বাংলাদেশকে প্রভাবিত করেছে।’
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এটা স্পর্শকাতর ইস্যু। যারাই বিজ্ঞাপন দিয়ে থাক, এটা খুঁজে বের করুক পত্রিকা অফিস বা সম্প্রীতি বাংলাদেশ। কারণ, এই বিজ্ঞাপনের জন্যতো পত্রিকা অফিসকে টাকা দিয়েছে। সেখানে অবশ্যই তাদের ঠিকানা দেয়া আছে। এটা বের করা কঠিন কিছু হবে না। যারা জড়িত তাদের বের করতে হবে, তদন্ত হওয়া দরকার। আইনের আওতায় আনা উচিত।’
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ’র অধ্যাপক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হাছনাত আলী বলেন, ‘৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে এই ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার দুঃখজনক। টাখনুর উপর কাপড় পরা ও দাড়ি রাখা ইসলামের বিধান। এই বিধান নিয়ে যদি কোনো বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে, তা নিন্দনীয়। এটির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।’
তিনি বলেন, ‘আর যদি সম্প্রীতি বাংলাদেশ বিজ্ঞাপন না দিয়ে থাকে, তাহলে সরকার বা পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এর সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের বের করা সংগঠনটির নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভুলভাল তথ্য দিয়ে শাক দিয়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়রা মাছ ঢাকার চেষ্টা করলেও সফল হবেন না।’ সূত্র : পরিবর্তন ডটকম।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন