সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে দূরত্ব কমাতে তৎপর কূটনীতিকরা
বৃহস্পতিবার ঢাকায় বিরোধী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে বিদেশি কূটনীতিকদের নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান জানানো হয়৷ সেখানে তারা তাদের সাত দফা দাবি এবং ১১ দফা লক্ষ্য তুলে ধরেন৷ তাদের মূল কথা ছিল, সমান সুযোগ দিয়ে অংশগ্রহণমূলক এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন৷ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ওই অনুষ্ঠানে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন৷ জোটের শরিক দলের নেতারাও ছিলেন৷ কূটনীতিকরা ঐক্যজোট নেতাদেরও কিছু প্রশ্ন করেন, যার জবাব দেন ড. কামাল হোসেন৷ মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা উইলিয়াম মুলার প্রশ্নগুলো করেন৷ আর সেই সব প্রশ্নের মধ্যে মূল প্রশ্ন ছিল ঐক্য ফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন৷ আর এর জবাবে ড. কামাল বলেছেন, সেটা সংসদই ঠিক করবে৷ এর বাইরে খালেদা জিয়াকে করাগারে রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন কিনা, জামায়াতের ব্যাপারে বিকল্প ধারার অবস্থান এবং জোটের বাইরে থাকার প্রশ্ন এসেছে৷ আর এই সব প্রশ্নের জবাব থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন এবং তাদের লক্ষ্য নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য করা৷
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, কাতার, মরক্কোসহ ৩০ টি দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন৷
একই দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাট ও ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা৷ ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠকের পর বার্নিকাট সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হতে পারে৷’’
আর শ্রিংলা সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘ভারত আশা করে আগামী একাদশ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে৷ আগামী নির্বাচন সামনে রেখে কোনো নাশকতার আশঙ্কা দেখছে না ভারত৷ আমরা আশা করি, সবার অংশগ্রহণে সুন্দর একটি নির্বাচন হবে৷’’ দু’টি দেশই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায়৷
তবে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, সংলাপের উপলক্ষ কিংবা পরিবেশ দেখছেন না তিনি৷ খালেদা জিয়া বন্দি থাকলেও, নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও তিনি মনে করেন৷
এদিকে ঢাকা সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়ন( ইইউ)-এর একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করেন৷ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ইইউ রাষ্ট্রদূত রেনজি তিরিংক৷ তিনি বলেন, ‘‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও পরিবেশ দেখতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইইউ-এর দু’জন প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসবেন৷ তাঁরা কয়েক সপ্তাহ এখানে অবস্থান করবেন৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ৷ এই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য কোনো সহযোগিতা করতে ইইউ প্রস্তুত৷’’
তবে নির্বাচনের সময় ইইউ কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবেনা৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ করলেও তারা রাজী হননি৷
প্রধান নির্বাচন কশিমনার তাঁদের জানিয়েছেন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে৷ নির্বাচন হতে পারে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে৷ নির্বাচন কমিশন সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে৷
কূটনীতিকদের এই তৎপরতা এবং ঐক্য ফ্রন্টের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের পরিস্থিতি জানানোকে অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেরই উদ্যোগ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সবাইতো একটা অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চায়৷ যেহেতু এটা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধীদের এক ধরনের দূরত্ব আছে, সরকারের দিক থেকে প্রতিযোগীদের কতটুকু সুযোগ দেবে তা নিয়েও সন্দেহ আছে৷ এই যে সিলেটে ঐক্য ফ্রন্টকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলো না, কেন দেয়া হলো না তার ব্যাখ্যা নেই৷ এইসব মিলিয়ে যে যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করছেন একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার৷ কূটনীতিকরাও চাইছেন সবার সঙ্গে কথা বলে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে যে দূরত্ব নির্বাচন নিয়ে, তা কমিয়ে আনতে৷ দূরত্ব যতটা কমিয়ে আনা যায়, তার মাধ্যমে মোটামুটি হলেও একটি অংশগ্রহমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়া৷ তবে এটা কতটুকু সফল হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি৷ আমার ধারণা, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, কূটনীতিকসহ সব মহলের এই তৎপরতা আরো বাড়বে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ঐক্য ফ্রন্ট স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়েই নির্বাচন পর্যন্ত যেতে চায়৷ তারা সহিংস হয় কিনা সেটাও পর্যবেক্ষণের বিষয় রয়েছে কূটনীতিকদের৷ কারণ, এইযে সিলেটে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলো না, কিন্তু ঐক্য ফ্রন্ট সেখানে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে৷ তাতে একটা সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে৷ কিন্ত এর দায় কার৷ আমার মতে সরকারের৷ সরকারও হয়তো এখন দেখাতে চায় তারা সহিংস হচ্ছে৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘নির্বাচনই শেষ নয়৷ এরপর সরকার গঠন কেমন হবে, সাধারণ মানুষের তাতে আস্থা আছে কিনা, এই বিষয়গুলোও বুঝতে চান কূটনীতিকরা৷ সে কারণেই হয়তো ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন– এ জাতীয় প্রশ্ন করেছেন তাঁরা৷’’
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘‘প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়৷ কারণ, উন্নয়ন সহযোগী এবং জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে একের প্রতি অন্যের একটা দায়িত্ব আছে৷ সেই চিন্তা থেকে এবং দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের যে একটি ধারা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকেই কূটনীতিকদের এই আগ্রহ এবং তৎপরতা৷ আর নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে অনেকগুলো আন্তর্জাতিক সংগঠন সারাবছরই কোনো-না-কোনো দেশের নিরিখে কাজ করে৷ এটা এক অর্থে রুটিন কাজ এবং আরেক অর্থে সিজনাল কাজ৷ আর সে কারণেই ঢাকার কূটনৈতিক মিশনগুলো তৎপর হয়েছে৷ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও তাদের টিম পাঠাচ্ছে৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন নিয়ে কী হচ্ছে এটা কূটনীতিকরা জানেন৷ তাই কৌতুহলের দিক থেকে তাঁরা ঐক্য ফ্রন্ট নেতাদের নানা প্রশ্ন করেছেন৷ আর বিএনপি যে কূটনীকিদের দাওয়াত দিয়ে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছে, এটা নতুন নয়৷ এরশাদ সরকারের আমল থেকেই সরকারি বা বিরোধী সবাই এটা করেছেন৷ তাঁরা চেয়েছেন একধরনের সুনজরে থাকতে৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ইইউ যে নির্বাচনের সময় পর্যবেক্ষক পাঠাবে না এর কারণ হলো নির্বাচন যখন রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়, অন্যকোনো গুরুত্ব না থাকে, তখন নজরদারির বিষয়টি তেমন থাকে না৷ তাই পাঁচ বছর আগে যে আগ্রহ ছিল, সেটা এখন নেই৷’’
যে পথে এগোতে চায় ঐক্য ফ্রন্ট:
ঐক্যফ্রন্ট কূটনীকিদের সঙ্গে এই বৈঠকের পর এখন সুশীল সমাজের সঙ্গে বসবে বলে জানা গেছে৷ তাঁরা সব মহলে তাঁদের অবস্থান তুলে ধরে জনমত গঠনের পাশাপাশি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চান৷ একই সঙ্গে দেখাতে চায় যে, সরকার তাদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দিচ্ছে৷ নির্বাচনে সব সুযোগের পথে সরকারই প্রধান বাধা৷ ২৩ অক্টোবর সিলেটে সমাবেশের অনুমতি না দেয়া হলেও তারা ওইদিন সিলেটে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন৷ তারাই চাইছেন, হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে নির্বাচনী কাজ শুরু করতে৷ তাতে যদি বাধা দেয়া হয়, তাহলে তারা কী করবেন সেই করনীয় ঠিক করতে শুক্রবার রাতে বৈঠক ডেকেছেন৷ বাধা পেলেও সেটা যেন তারা তাদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারেন, সেটাই তারা চাইছেন৷
জানা গেছে, ৩০ অক্টোবরের মথ্যে তারা বিভাগের সমাবেশগুলো শেষ করবেন৷ নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পররই তারা সারাদেশে লংমার্চের কর্মসূচি দিতে পারেন৷
বিকল্প ধারায় ভাঙন:
এদিকে ঐক্যফ্রন্টে না আসা ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারায় ভাঙন দেখা দিয়েছে৷ বিকল্প ধারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরীকে দল থেকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করেছে আরেকটি গ্রুপ৷ শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিকল্পধারার কেন্দ্রীয় নেতা ড. নুরুল আমিন ব্যাপারি৷ তিনি নিজেকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন। তাঁর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাহ আহম্মেদ বাদলের নাম ঘোষণা করা হয়৷ সংবাদ সম্মেলনে নুরুল আমি ব্যাপারি জানান, তাঁরা ঐক্য ফ্রন্টে থাকবেন৷
-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন