সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবে কে?
গওহার নঈম ওয়ারা : চুকনগর সড়কের দুপাশে আবার মানুষের অস্থায়ী টং/ছাপরা উঠছে। সেখানে রাতে থাকছে মানুষ। বাস, ট্রাক আর মোটরগাড়ির চাপা খাওয়ার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে তারা থাকে। কেশবপুর যশোরের একটি জনপদ। ফি বছর জলাবদ্ধতার শিকার হওয়া এক দুর্গত জনপদ। গত বছর প্রায় এই সময় রাস্তার পাশে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের মধ্যে চারজন ট্রাকচাপায় মারা যায়। আতঙ্কিত আর আহত হওয়ার সংখ্যার কোনো শুমার ছিল না তখন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ শ্রেণি বোঝে না, ধর্ম বোঝে না। কিন্তু আশ্রয় ও সহায়তার শ্রেণিচরিত্র আছে, জাত-পাত-ধর্ম আছে। কেশবপুরের ‘অচ্ছুত’ মানুষদের, তাই রাস্তায় আশ্রয় ছাড়া আর কোনো গতি নেই। এবারও পানিতে আটকে গেছে তাদের গ্রামগুলো। ‘অচ্ছুত’ মানুষ, যাদের আমরা ঢং করে ঋষি (ভগবান বা হরিজন) বলি, তাদের সমস্যা সবচেয়ে বেশি। একাত্তর সালে চরম জোর-জুলুম, অগ্নিসংযোগ, ধর্মান্তর, ধর্ষণের মুখেও কেশবপুরের এই ঋষিপল্লিগুলোর লোকজনকে ভিটেছাড়া হতে হয়নি। এখন স্বাধীন দেশের উন্নয়নের ঠেলায় তারা কুপোকাত। চিৎপাত হতে হচ্ছে সড়কে-মহাসড়কে। গত বছরের জলাবদ্ধতার প্রথম ধাপে তারা শুকনা স্কুল-কলেজে ঠাঁই নিলেও সেখানে টিকতে পারেনি। সংখ্যাগুরু আশরাফ শ্রেণির মানুষেরও তো ঘরবাড়ি ডুবেছে, আশ্রয়ের ‘অধিকার’ তাদের তো আরও বেশি! তাদের জায়গা দেওয়ার প্রয়োজনে কোণঠাসা হয়ে পড়ে আতরাফ শ্রেণির ঋষিপল্লির বাসিন্দারা। ঘর থেকে বারান্দায় তারপর আবার রাস্তায় ঠেলে দেওয়া হয় তাদের।
রাস্তার পাশে ট্রাকের চাপায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটার পর নিরুপায় হয়ে তারা আবার ফিরে যায় কাদা-পানিতে সয়লাব হওয়া ভিটেয়। সে করুণ মানবিক বিপর্যয়ের কথা লিপিবদ্ধ করার কালি কোথাও ছিল না। কালিমার কথা কালিতে লেখে কেমনে! ঋষিপল্লির কপর্দকশূন্য লোকজনের আশপাশের জমি ছিলে বলে বাটপারি করে বাগিয়ে নিয়ে কেউ বাগান বানিয়েছে, কেউ খুঁড়েছে পুকুরের পর পুকুর। উঁচু পাড়ের সেসব ফাঁদ পাতা পুকুর টপকে পানি যেতে পারে না ভদ্রা নদীতে। ভদ্রলোকেরা ভদ্রাকে বধ করেছে—জলপানি কিছুই আর বইতে পারছে না ভদ্রা।
কেশরপুরের জলাবদ্ধতার খবর আজকালের মধ্যে হয়তো মিডিয়ায় ঢেউ তুলবে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বড় রাস্তা চুকনগর সড়কের গা ভেজেনি, তাই বোধ হয় খবর হয়নি। তা ছাড়া হাওর, পাহাড়ধস, নগরবন্যা, নৌকার পাশে রিকশা, বাস প্রভৃতির ভিড়ে অসহায় ঋষিদের জায়গা কোথায়!
গত বছর এসব মানুষের চরম ভোগান্তির পর সাধারণ মানুষের দানের টাকায় পানিবন্দী গ্রামগুলোর পাঁচ হাজার ঘরের মধ্যে মাত্র শ দুয়েকের বাড়ি উঁচু করে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে ছিল বানের সময় ব্যবহার করা যায়—এমন টয়লেট আর বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা। একটা স্কুলঘরও চালু করেছিল ব্র্যাক। ঘরবাড়ি, টয়লেট, স্কুলের কায়িক পরিশ্রমের কাজ করেছিল গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে। কিশোরীরা গ্রামবাসীর সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছিল কারা ভিটা উঁচু আর ঘরবাড়ি তৈরির কাজে সহযোগিতা পাবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও পল্লি পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষকেরাও এগিয়ে এসেছিলেন বুদ্ধি নিয়ে সেই কর্মযজ্ঞে। সেসব ঘরবাড়ি এখনো জেগে আছে পানির ওপরে। কিন্তু তাও তো মাত্র দুই শ—পাঁচ হাজারের মধ্যে। ভূমি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ছাড়া এসব অব্যবস্থাপনার বন্যা আর জলাবদ্ধতা আটকানো যাবে না।
মন্ত্রী, এমপিরা গতবারেও ভদ্রার বুকে খননযন্ত্র চালিয়ে বুক-পেট সোজা করার ব্যয়বহুল যজ্ঞ শুরু করেছিলেন। মিডিয়ার সামনে বুক চিতিয়ে বলেছিলেন, আর জল আটকাবে না, ভদ্রা সোজা হয়ে গেছে। কিন্তু সবই গরল ভেল; জলাবদ্ধতা যা ছিল তা-ই আছে।
এখনো আসল বর্ষা বাকি, মানুষ সড়কের পাশে চৌকি পাতছে। আমরা কি কিছু বুঝতে পারছি?
লেখক : বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন