সাতক্ষীরায় প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিত করে চেয়ার দখল, ভিডিও ভাইরাল

সাতক্ষীরা সদরের বল্লী মোঃ মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক এ.কে.এম আজহারুজ্জামান মুকুলের বিরুদ্ধে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ জামিলুজ্জামানকে মারপিটসহ লাঞ্ছিত করে চেয়ার দখলের অভিযোগ উঠেছে। একই সাথে দুই দফায় প্রধান শিক্ষকের বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি ওই প্রধান শিক্ষককে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেওয়ার একটি ভিডিও ফুটে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী প্রধান শিক্ষক জামিলুজ্জামান সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, আর্মি ক্যাম্প কমান্ডার, শিক্ষা বোর্ড সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

ভাইরাল হওয়া দুটি ভিডিওতে দেখা গেছে, স্কুল চত্বরে বহিরাগত কিছু লোকজন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জামিউলুর রহমানকে মারপিট করে স্কুল থেকে বের করে দিচ্ছে। অপর একটি ভিডিওতে দেখা গেছে প্রধান শিক্ষকের রুমে অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক এ কে এম আখতারুজ্জামান মুকুল চেয়ার দখল করে উপস্থিত লোকজনকে বলছে, জামিল স্যারের ব্যাপারে কয়েকজন আমাকে কল দিয়েছে।

আমি তাদেরকে বলেছি আমার রাজ্যে আমি রাজা, কারোর কথা শোনার সময় আমার নেই। জামিল স্যার কি আমরা আর এই চেয়ারে বসতে দেবো না। আমি বলে দিয়েছি তাকে স্কুলে না আসতে। স্কুলে আসার আগে আকড়াখোলা ব্রিজ পারহলেই তাকে কবরে পাঠানো হবে।

জানা গেছে, অভিযুক্ত এ.কে.এম আজহারুজ্জামান মুকুল প্রতিষ্টানটি’র সহকারি শিক্ষক পদে থাকলেও তিনি দীর্ঘ ১২ বছর বিদ্যালয়ে অনিয়মিত ছিলেন। বিদ্যালয়ে অনিয়মত থেকেও বেতনভাতা তোলার অভিযোগ ও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সাম্প্রতি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ঘটলে তিনি বল্লী ইউনিয়ন জামায়াত ইসলামী’র সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকায় এলাকায় নানাবিধ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়েছেন।

লুটপাট সহ নানাবিধ হয়রানির অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এদিকে, প্রধান শিক্ষক মোঃ জামিলুজ্জামানকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়েছে আজহারুজ্জামান মুকুল। তেমন-ই একটি ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় রিতিমত ভাইরাল হয়েছে।

ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, মোঃ জামিলুজ্জামান বল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০০২ সালে সহকারি শিক্ষক হিসাবে চাকুরিপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালে যথারীতি নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন এবং এমপিও ভুক্ত হন। বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শুণ্য থাকায় বিধি মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি যথাযথ দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

এদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন অর্থাৎ ৬ আগস্ট ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোঃ জামিলুজ্জামান অফিসে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এমন অবস্থায় সহকারী শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুলের নেতৃত্বে বেশ কিছু বহিরাগত বিদ্যালয় প্রবেশ করে প্রধান শিক্ষককে কক্ষ থেকে বাহিরে এনে মারপিট করেন এবং প্রকাশ্যে শিক্ষার্থীদের সামনে লাঞ্ছিত করেন।

একই সাথে পর্যায়ক্রমে দুইদিন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বাড়ীতে ভাংচুরসহ লুটপাট করেন। এ ঘটনার পরে সহকারী শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুল অবৈধভাবে ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে মোঃ জামিলুজ্জামানকে প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অব্যহতি দিয়ে নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। সমস্ত বিষয়টি লিখিতভাবে ভুক্তভোগী শিক্ষক সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সেনাবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডার, শিক্ষা বোর্ড সহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে বল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আব্দুল আলীম বলেন, সরকার পতনের পরেরদিন স্কুলে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা রিতিমত লজ্জাজনক। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক যথারিতি অফিসে কাজ করছিলেন আকস্মিক সহকারী শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুল সহ বেশ কিছু বহিরাগত স্কুলে প্রবেশ করে প্রধান শিক্ষককে টেনে হেঁচড়ে বাইরে এনে মারপিট সহ লাঞ্ছিত করেন।

পরবর্তীতে প্রধান শিক্ষকের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। এরপরে সহকারি শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুল নিজেকে প্রধান শিক্ষক দাবি করে অফিস বসছে। যেটা সম্পূর্ণ নিয়ম পরিপন্থী। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের সঙ্গে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

সিনিয়র শিক্ষক সাইদুর রহমান বলেন, সম্পূর্ণ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে অপমান অপদস্ত এবং লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এই সমস্ত কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছেন সহকারী শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুল সহ বেশ কয়েকজন বহিরাগত লোকজন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এখন আজহারুজ্জামান মুকুল কিন্তু খাতা-কলমে কিংবা নিয়ম অনুযায়ী প্রধান শিক্ষক হলেন জামিললুজ্জামান জামিল।

একই সাথে ২২ শে আগস্ট থেকে ছয়জন শিক্ষককে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে স্বশরীরে হাজির হয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জেলা শিক্ষা অফিসারকে অবহিত করা হয়েছে। বিষয়টা তারা দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

ভুক্তভোগী বল্লী মোঃ মুজিবুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক(ভারপ্রাপ্ত) মোঃ জামিলুজ্জামান বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী ২০০২ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানে আমি যোগদান করি। পরবর্তীতে ২০২২ সালে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে সহকারি প্রধান শিক্ষক হয়েছি। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটিতে প্রধান শিক্ষকেরর পদ শূণ্য সেক্ষেত্রে সরকারি প্রধান শিক্ষকই ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।

যেটি আমি দীর্ঘদিন পালন করে আসছি। সরকার পতনের পরের দিন বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুল ও বেশ কিছু অপরিচিত মানুষ আকস্মিক এসে আমাকে অফিস থেকে টেনে বের করে প্রচন্ড মারপিট করে এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামনে লাঞ্ছিত করে। একই সাথে আমার বাড়িতে দুই দফায় ভাঙচুর চালায় তারা।

বিদ্যালয়ে গেলে আমাকে মেরে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে সহকারি শিক্ষক আজহারুজ্জামান মুকুল, যে ভিডিও ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এ বিষয়ে শিক্ষা বোর্ড, ডিসি, সেনাবাহিনী সহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত সহ ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।

তিনি আরও জানান, অভিযুক্ত সরকারি শিক্ষক আজারুজ্জামান মুকুল বল্লী ইউনিয়ন জামায়াত ইসলামী’র সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন। তিনি এই পদকে ব্যবহার করে ইতোমধ্যে অনেক অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনা করেছেন। সেই ঘটনার অংশ বিশেষ আমাকে মারপিট সহ কর্মস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। আমাকে বিদ্যালয় থেকে মারপিট করে বের করে নিজেকে প্রধান শিক্ষক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে অফিসে বসছেন। যে শিক্ষকরা তাকে মানতে চাইনা তাদের বিরুদ্ধে তিনি ষড়যন্ত্র করছেন।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত এ.কে.এম আজহারুজ্জামান মুকুল বলেন, হামলা ও লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে আমি কোন ভাবে জড়িত নই। তবে যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে সেটি আমার।

এসব বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা জামায়াত ইসলামের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান বলেন, বল্লী ইউনিয়ন জামায়াত ইসলামের সাধারণ সম্পাদক আজহারুজ্জামান মুকুলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি পেয়েছি সেটি নিঃসন্দেহে সংগঠন শর্ত ভঙ্গ করে। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখার মত। তদন্তে যদি সত্যতা মেলে সেক্ষেত্রে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শোয়াইব আহমাদ বলেন, বল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক স্বশরীরে এসে বেশ কিছু বিষয় অভিযোগ জানিয়েছেন। অভিযোগের মধ্যে একটি হল তাদেরকে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে দেওয়া হচ্ছে না। আগামী রবিবার ওই বিদ্যালয়ে যাবো এবং উভয় পক্ষকে নিয়ে বসাবসি করা হবে। পরবর্তীতে রিপোর্ট বোর্ডে পাঠানো হবে।