সাতক্ষীরার কলারোয়ায় একই পরিবারের ৪জনকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা

সাতক্ষীরার কলারোয়ায় একই পরিবারের চারজনকে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। প্রাণে বাঁচলো ৬ মাসের শিশু মারিয়া।

বৃহস্পতিবার ভোর রাতে উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলিশা গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। বাড়িটি হেলাতলি ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী। ঘরের মধ্য থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একটা লাশের পা বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়।

নিহতরা হলেন- হেলাতলা খলসি গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে শাহিনুর রহমান (৪০), তার স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩৫), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহি (১০) ও মেয়ে তাসনিম (৮)।
এ ঘটনায় শাহিনুরের ছয় মাস বয়সী অপর শিশু কন্যা সন্তান মারিয়া অক্ষত আছে।
নিহত শাহিনুর পোনা মাছ ব্যবসায়ী ছিলেন। পুকুরে মাছের চাষ করতেন তিনি।

পুলিশের ধারণা, গতরাতে চিলেকোঠা দিয়ে (ছাদের ঘর) দিয়ে দুর্বৃত্তরা ঘরে ঢুকে এই চারজনকে কুপিয়ে হত‌্যা করেছে।

এ ঘটনায় তাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশি ও সাধারণ মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। চারটি তরতাজা মানব সন্তানের জবাই করা লাশ দেখে তারা এখন হতভম্ব। হত্যার আগে অথবা পরে তারা পরিবার প্রধান শাহিনুরের হাত পার রগ কেটে বেঁধে রেখে যায়।

খবর পেয়ে সকালেই পুলিশের খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি একে এম নাহিদ, সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান (পিপিএম) বার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর্জা সালাহউদ্দিন, পিবিআই, র‌্যাব, ডিবি, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। দুপুরে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, কলারোয়ার ইউএনও মৌসুমী জেরিন কান্তা, এসিল্যান্ড আক্তার হোসেন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। বিকেলে সেখানে ছুটে যান সাতক্ষীরা-১ আসনের সংসদ সদস্য এড.মুস্তফা লুৎফুল্লাহ এমপি। তিঁনি জীবিত শিশুর খোঁজখবর নেন। একই সাথেও হত্যার শিকার মাগফিরাত কামন করে দোষিদের দ্রুত শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির দাবি জানান।

ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান পিপিএম (বার) বলেন, ‘হত্যা করা হয়েছে কুপিয়ে ধারালো অস্ত্র দিয়ে একজন পুরুষ, একজন মহিলা, একটা ছেলে বাচ্চা এবং একটা মেয়ে বাচ্চাকে। আমরা এখানে এসেছি, প্রাথমিকভাবে এটাকে আমরা প্রিজার্ভ করেছি এবং কিভাবে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, যে ধারালো অস্ত্রের মাধ্যমে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে সেগুলো শনাক্ত করেছি। পাশাপাশি সম্ভাব্য কারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে অথবা কি কারণে সংঘটিত হতে পারে সেগুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করছি এবং সেটা তদন্ত সাপেক্ষে আমরা পরবর্তীতে জানাবো। তবে যে বা যারা এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকুক না কেন তাদেরকে অনুসন্ধানের মাধ্যমে খুঁজে বের করা হবে এবং ঘটনা সঠিকভাবে তদন্ত করা হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে এসপি বলেন, ‘সম্ভাব্য যতগুলো বিরোধ থাকতে পারে আমরা সবগুলো পর্যবেক্ষণ করব। সব গুলোকে আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখবো এবং সেটি কি কারণে সংঘটিত হয়েছে সেটা অবশ্যই তদন্তের মাধ্যমে বের করা হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত কাউকে এভাবে আমরা প্রমানভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করিনি। আমরা আগে বিষয়গুলো ভালভাবে দেখছি। দেখার পরে যদি কারো নাম আসে তখন তাদেরকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করব।’

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার আরো বলেন, এই দুঃখজনক ঘটনার তদন্তে নেমেছি আমরা। হত্যাকরীদের অবিলম্বে খুঁজে বের করে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে। ঘাতক যেই হোক তারা রক্ষা পাবে না।

কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি হারান চন্দ্র পাল বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ‘হত্যাকাণ্ডের কারণ এখনো জানা যায়নি। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সাতক্ষীরা মর্গে পাঠানো হয়েছে। মামলা প্রক্রিয়াধীন।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঘটনাস্থল থেকে সিআইডির ক্রাইম সিন, গোয়েন্দা পুলিশ, ডিএসবি, র‌্যাব এবং অন্যান্য গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করেছেন। হত্যার মোটিভ উদঘটনে থানা পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক টিম কাজ শুরু করেছে।’

এদিকে, ৫ মাস বয়সী শিশুটির দায়িত্ব গ্রহন করেছেন সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল। তিনি শিশু মারিয়া সুলতানাকে হেলাতলা ইউনিয়নের ৪,৫,৬নং ওয়ার্ডে সংরক্ষিত ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুনের কাছে শিশুটিকে আপাতত রাখার নির্দেশনা দেন। এখন থেকে তার চিকিৎসা এবং জীবন গড়ার যাবতীয় দায়িত্ব জেলা প্রশাসক গ্রহন করেছেন বলে ঘটনাস্থলে যেয়ে তিনি ঘোষনা দেন।

পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, নিহত শাহিনুরেরা তিন ভাই ও এক বোন, এক ভাই আশরাফুল মালায়েশিয়া থাকেন।
ঘটনার রাতে নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই রায়হানুল ইসলাম বাড়ির অন্য ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন।

রায়হানুল ইসলাম জানান, ‘বাড়িতে মা ও বড় ভাইয়ের পরিবারের ৪জনসহ তারা ছয়জন থাকতেন। মা কাল আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলেন তুলসীডাংগা গ্রামে। তিনি (রায়হানুল) ছিলেন পাশের ঘরে। ভোরে পাশের ঘর থেকে তিনি বাচ্চাদের গোঙানির (ব্যথার আওয়াজ) শব্দ শুনতে পান। তাৎক্ষণিক এগিয়ে গিয়ে দেখেন ঘরের বাইরে থেকে আটকানো। পরে গেটের তালা ভেঙ্গে ঘরের দরজা খুলে দেখতে পায় ভাই ও ভাবির নিথর দেহ পড়ে আছে। অপর ঘরের দরজা খুলে দেখতে পায় ভাইপো সিয়াম ও ভাইজি তাজনিমের মৃত্যু দেহ পড়ে আছে। আর ওই ৬ মাসের শিশুটি অক্ষত অবস্থায় দোলনায় শুয়ে কাঁদছে। তাদের মধ্যে ভাই শাহিনুরের পা রশি দিয়ে বাঁধা এবং তার পা ও হাতের রগ কাটা। পরে তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলে পাশ্ববর্তী লোকজন ছুটে আসে।’

তিনি আরও জানান, ‘তাদের সাথে জমি জায়গা নিয়ে পাশের কিছু লোকের বিরোধ ছিল। কিন্তু কারা এ ঘটনা ঘটালো তা বুঝতে পারছি না।’

স্থানীয়রা জানান, ভোরে তারা ওই বাড়ির চিৎকার চেচামেচি শুনে ছুটে যান, পরে দরজা খুলে দেখতে পান সাবিনা খাতুন, তার দুই শিশু সন্তান তাসমিন ও তাসিম এক ঘরে ও আরেক ঘরে শাহিনুনের জবাই করা লাশ। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌছায়।

ভাই রায়হানুল ইসলাম আরও জানান, তার বড়ভাই শাহিনুর ইসলাম নিজস্ব ৭-৮ বিঘা জমিতে পাঙাস মাছ চাষ করতেন। গত ২২ বছর ধরে তাদের পারিবারিক জমি নিয়ে নিকট প্রতিবেশী ওয়াজেদ কারিগরের ছেলে আকবরের সাথে মামলা চলছিল। এই মামলা ও পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকান্ড ঘটে থাকতে পারে বলে তার ধারনা।

নিহত শাহিনুরের খালাতো ভাই হাসানুর রহমান জানান, তার ভাইয়ের সাথে কারোও কোন শত্রুতা ছিল না। কেবলমাত্র জমিজমা নিয়ে আকবরের সাথে ২২ বছর মামলা চলছে।
তিনিও এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের ফাঁসি চান।

পরিবারের স্বজন ও প্রতিবেশিরা জানান, কলারোয়া উপজেলার দামোদরকাটী গ্রামের নূর আলীর ছেলে জনৈক আকবর হোসেনের কাছ থেকে ৩৪ শতক জমি ক্রয় করেন প্রতিবেশি ওয়াজেদ আলির ছেলে আকবর আলি। এর মধ্যে কিছু জমি নিয়ে আকবরের সাথে শাহিনুরের মামলা চলছিল। এই বিরোধ ছাড়া শাহিনুর পরিবারের সাথে কারো কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।

ঘটনাস্থলে গিয়ে আরো জানা যায়, জীবিত থাকা একমাত্র শিশু কন্যা মারিয়া সুলতানাকে স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুন নিরাপত্তার জন্য নিয়ে যান। পরে তিনি তাকে আত্মীয়দের কাছে হস্তান্তর করেন।

নিহত শাহিনুরের একমাত্র বোন আছিয়া খাতুন বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন। তিনি বলছেন, আমার মা ও আরেকটা ভাই এখানে থাকলে তাদেরকেও খুন করতো সন্ত্রাসীরা।

স্থানীয় হেলাতলা ইউপি চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করে বলেন, ‘পরিবারটি ছিল অত্যন্ত নিরীহ। তারা কোন দল করতো না। কারো সাথে তাদের বিরোধও ছিল না।’

কলারোয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, ‘নিজেদের ঘরের মধ্যে গৃহ প্রধান শাহিনুর রহমানসহ চারজনকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে শাহিনুরের পা বাধা ছিল এবং তাদের চিলে কোঠার দরজা খোলা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে ছাদের চিলে কোঠার দরজা দিয়ে হত্যাকারীরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। ঘটনার রহস্য উন্মোচনে থানা পুলিশ কাজ করেছে।’

নিহত শাহিনুরের এক মাত্র বোন আছিয়া খাতুন জানায়, তার বড়ভাই শাহীনুর ইসলাম নিজস্ব ৭-৮ বিঘা জমিতে পাঙাস মাছ চাষ করে সংসার জীবন চালিয়ে আসছেন। তাদের বাবা মৃত শাজাহান আলী কলারোয়ার দামোদরকাটী গ্রামের নূর আলীর ছেলে আকবর হোসেনের কাছ থেকে ৩৪ শতক জমি ক্রয় করেন। এই জমির ওই জমি নিয়েই ঝামেলা চলে আসছিলো। এ নিয়ে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দপ্তরে এই মাসের শালিস হওয়ার কথা ছিলো।

স্থানীয় ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুন জানান, শাহীনুর রহমান ও ছোটভাই রায়হানুল ইসলামের সাথে ভাইয়ে ভাইয়ে মিল ছিলো। জমি ছাড়া আর কারো সাথে বিরোধ ছিলো না। গতকাল তাদের পরিবারের চার জন খুন হওয়ার খবর শুনে তিনি ছুটে আসেন। বেঁচে থাকা ৫ মাস বয়সেরএকমাত্র শিশুসন্তানকে নিজ হেফাজতে রাখেন।

লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীকারী কলারোয়া থানার এস আই ই¯্রাফিল জানান, সকালে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। নিহত শাহীনুরের হাত পা বেঁধে ঘরের খাটের উপর উপড়করে হত্যা করা হয়। তার পায়ের রগকাটা হয়। মাথায় ধারাল অস্ত্রের আঘাত আছে। শাহীনুরের স্ত্রী ও সন্তানদের লাশ পাশের রুমে পাওয়া যায়। তাদের সবাইকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে গলার শ্বাসনালী কেটে দেয়া হয়। ঘটনাস্থলে পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা আসার পর বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে ময়না তদন্তের জন্য লাশ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, রায়হানুল ইসলাম গত চার বছর আগে পার্শ্ববর্তী মৃত খালেক শেখের কন্যা ফাইমা খাতুনের সাথে প্রেম করে। ফাইমা স্বামীর ঘর ছেড়ে রায়হানুলের সাথে ফাইমা বিয়ে করলে বড় ভাই শহিনুরের সাথে ছোটভাইয়ের ঝগড়া বিবাদ হয়। এক পর্যায়ে গত ৫ মাস আগে বড় ভাইয়ের পিড়া পিড়িতে ছোটভাই রায়হানুল ইসলাম ফাইমাকে তালাক দেয়। ফাইমা এটা মানতে না পেরে রায়হানুলের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখে। রায়হান তাকে ফের বিয়ে করতে চাইলে ভাই ও ভাবীদের সাথে তার অশান্তিও হতে দেখা যেত। এর মধ্যে রায়হানুল মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। তার নামে কলারোয়া থানায় একাধিক মাদকের মামলাও আছে। এ হত্যার পেছনে এসব কারনও থাকতে পারে।

নিহত শাহীনুরের মা শাহিদা খাতুন (৬০) আহাজারি করে বলছেন তিনি বাড়িতে থাকলে তাকেও হয়ত খুন হতে হতো। তিনি বলেন, আমার ছেলে বৌমা হত্যাকারীদের চিনতে পারায় একে একে সবাইকে জবাই করে হত্যা করেছে। তিনি এই নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচার দাবি করেন।

 

এসপি’র বক্তব্য (সংগৃহীত):

কলারোয়ায় এক পরিবারে ৪ জন খুন।

Publiée par Kalaroa News sur Mercredi 14 octobre 2020