সান্তাহার-রহনপুর রেলপথ প্রকল্প, লালফিতায় বন্দি বরেন্দ্রবাসির শতবর্ষের স্বপ্ন!
ব্রিটিশ পেরিয়ে পাকিস্তান। পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ ছিলো বাঙালি জাতি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলার দামাল ছেলেরা লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। বাঙালি ফিরে পেলো স্বাধিকার।
শাসনব্যবস্থায় এলো পরিবর্তন। এরপর কেটে গেলো ৫১ বছর। তবুও অন্ধকারেই রয়ে গেছে দেশের খাদ্যভান্ডার বলে পরিচিত বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের শতবর্ষের স্বপ্ন। বলছি- ১১৩ বছর আগে ব্রিটিশ সরকারের নেওয়া সান্তাহার-রহনপুর রেলপথ
প্রকল্পের কথা। পাকিস্তান আমলেও প্রকল্পটির বিষয়ে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তারপর সময়ের স্রোতে তা আবার আঁধারে হারিয়ে যায়।
উত্তরাঞ্চলের প্রসিদ্ধ রেলওয়ে জংশন বগুড়ার সান্তাহার থেকে নওগাঁ হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রহনপুর পর্যন্ত মাত্র ৯৯ কিলোমিটার রেলপথের বিষয়ে রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কম প্রতিশ্রুতি মেলেনি।
কিন্তু দেশের অন্যতম আম ও ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষের জনগুরুত্বপূর্ণ এই দাবি বাস্তবায়নে কোনো সরকারই কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে একশ বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও কেনো আলোর মুখ দেখেনি এমন প্রশ্ন এখনও সচেতন মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখলে কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য স্বল্পমূল্যে সহজে দ্রুত পরিবহন ও বিপণনের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে। এতে অর্থনীতির প্রসার ঘটবে; বরেন্দ্র অঞ্চল হবে আরও সমৃদ্ধ। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সরকারি ফাইলে লালফিতায় বন্দি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ রেলপথ বাস্তবায়িত না হওয়ায় এলাকায় যোগ্য জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব না থাকাকেই দায়ী করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কপথ ছাড়া নওগাঁর সঙ্গে অন্য কোনো জেলার সংযোগ নেই। তাই এ জেলাকে বলা হয় “পকেট ডিস্ট্রিক্ট”। নওগাঁয় রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম বলে মনে করেন তারা। এদিকে, অবশ্য বিভিন্ন সময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের
কর্তাব্যক্তিরা সান্তাহার-রহনপুর রেলযোগাযোগের বিষয়ে আশার বাণী শোনালেও কবে নাগাদ এই রেললাইন নির্মাণ শুরু হতে পারে, সুনির্দিষ্টভাবে তা জানাতে পারছেন না কেউই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯১০ সালে ব্রিটিশের ইস্টার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে সরেজমিন সার্ভে (জরিপ) সম্পন্ন করে। জরিপদলের প্রধান ডেলগ্রিন তার প্রতিবেদনে বগুড়ার সান্তাহার জংশন থেকে নওগাঁর উপর দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পর্যন্ত ৯৯ কিলোমিটার রেলপথ অবিলম্বে নির্মাণ করা আবশ্যক বলে মতামত দেন। সে সময় একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ব্রড ও মিটার গেজ দুই ধরনের লাইনের এই নতুন রেলপথে ১১টি স্টেশন রাখার কথা ছিল।
স্টেশনগুলো হলো, নওগাঁ শহর, হাটহাপানিয়া, হযরতপুর, জাহাঙ্গিরাবাদ, মহিষবাথান, নজিপুর, মধইল, সাপাহার, পোরশা, মামুদপুর, দাউদপুর। নওগাঁ ডিগ্রি কলেজ এলাকায় ছোট যমুনা নদী ওপত্নীতলা উপজেলার নজিপুরে আত্রাই নদীর উপর একটি করে সেতু নির্মাণও প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের ক্রমাগত দাবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকারের রেলওয়ে বোর্ড ১৯৬৩ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে পুনরায় কাজ শুরু করে। তৎকালীন রেলওয়ে বোর্ড আরেকটি জরিপ চালায়। জরিপদলের প্রধান আশরাফ আলী ডেলগ্রিনের প্রতিবেদনের পক্ষে মত দেন।
তিনি ১৯৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে প্রকল্পের একটি নকশা (ব্লুপ্রিন্ট) ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। সবকিছু সম্পন্ন হওয়ার পরও রেলওয়ে বোর্ড
হঠাৎ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে শুরু হয় ১৯৬৬ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬৯-এ পূর্ব-বাংলার গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন; ১৯৭১-এ মুক্তি সংগ্রাম; বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আশার সঞ্চারিত হলেও ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনায় সান্তাহার-রহনপুর রেলওয়ে প্রকল্পটি আলোচনার স্থান পায়। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
২০২১ সালের দিকে নওগাঁ-২ আসনের সংসদ সদস্য শহীদুজ্জামান সরকার এটি বাস্তবায়নের দাবি সংসদে উত্থাপন করেন। কিন্তু কোনো সাড়া মিলেনি। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে একদিকে যোগাযোগ ও অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ স্থলবন্দর থেকে নওগাঁ, সান্তাহারসহ দেশ-বিদেশের পণ্য সামগ্রী অল্প ব্যয়ে আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। শুধু তাই
নয়, ভারত ও নেপালের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও প্রসারিত হবে।
নওগাঁর আল-ইমরান, আরমান হোসেন, রফিকুল ইসলামসহ ২০-২২ জন কলেজ শিক্ষার্থী জানান, ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর নওগাঁবাসির শতবর্ষের প্রাণের দাবি রেলপথ। সরকার এ জেলার উন্নয়নে নজর দিলেও রেলপথের স্বপ্ন আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে। রেলপথ নির্মাণ করলে কৃষিপণ্য পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। তৈরি হবে নতুন নতুন শিল্প-কারখানা, বাড়বে কর্মসংস্থান, যা দেশের জিডিপিতে অবদান রাখবে।
সান্তাহার-রহনপুর রেলপথ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য
প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন তারা। নওগাঁ সদর উপজেলার হাপানিয়া এলাকার রহমত আলী, তরিকুল ইসলাম, তাহের আলী ও মহাদেবপুর উপজেলার মাজহারুল হোসেন জানান, এখন সারাবছরই বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু স্থানীয় বাজারে দাম পায় না কৃষক। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত আম, ধানসহ নানা কৃষিপণ্য দেশের বিভিন্নস্থানে কম খরচে পাঠানো যাবে। একই কথা জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলের আরও ৩০-৩৫ জন কৃষক।
নওগাঁ জেলা প্রশাসক খালিদ মেহেদী হাসান জানান, সম্ভাব্যতা যাচাই করে বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। মুঠোফোনে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক (পশ্চিম) অসীম কুমার তালুকদার বলেন, এ ব্যাপারে আমার কিছুই জানা নেই। এটি আপনার কাছে প্রথম শুনলাম।
সান্তাহার-রহনপুর রেলপথ প্রকল্পের বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ইয়াসীন এর বক্তব্য জানতে মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া টেলিফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকায় তার
মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন