সাফল্য অর্জনকারী ৩ জয়িতা নারীর গল্প

জয়িতা হচ্ছে সমাজের সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীর একটি প্রতিকী নাম। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে প্রতিবছর দেশব্যাপী “জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ” শীর্ষক অভিনব প্রচারাভিযানের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃণমূলের সফল নারী, তথা জয়িতাদের অনুপ্রাণিত করা।
এরই ধারাবাহিকতায় নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলায় ২০২৫ সালে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিশেষ সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ জয়িতা হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন ৩ জন আত্মপ্রত্যয়ী এবং সংগ্রামী নারী। নিভা ধানোয়ার, বিথি রানী ও প্রতিমা রাণী।
শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ জয়িতা নিভা ধানোয়ারঃ মানুষের জীবনে বাধা বিপত্তি আসে কিন্তু এই বাধা বিপদে অপেক্ষা করে যারা জীবনকে অর্থবহ করতে চায়, সফলতা তার কাছে হার মানে। এরই এক অনন্য উদাহরণ নিভা ধানোয়ার।
নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার পত্নীতলা ইউনিয়নের বুজরুক মামুদপুর আদিবাসী গ্রামের কৃষক বিরেন ধানোয়ার ও তিতো বালার ঘরে ১৯৯৪ সালে জন্ম নিভার। চার ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান তিনি। তার যখন দেড় বছর বয়স তখন তার পোলিও হয়। তার মা তাকে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার তাকে ইনজেকশন দেন। কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস, তার পা পঙ্গু হয়ে যায়। ভালো ভাবে জন্ম হলেও তিনি হয়ে যান প্রতিবন্ধী। ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তার সারা জীবন পরিবার এবং নিজের কাছে বোঝায় পরিণত হন।
এভাবে তার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাকে অন্য বাচ্চাদের মতই স্কুলে ভর্তি করে দেয় পরিবার। নিভা দুই হাতে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে আধা কিলোঃ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেত। এভাবে বাড়ির পাশের স্কুল থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে রাজশাহী প্রতিবন্ধী মিশনে ভর্তি করে দেন তার বাবা-মা। ২০০৬ সালে রাজশাহী বাগানপাড়া মুক্তদাতা জুনিয়র হাইস্কুলে ৪র্থ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
এরপর শহীদ মুন স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হন এবং ২০১২সালে এস.এস.সি পাস করে হাজি জমির উদ্দিন শাফিনা মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে তিনি ডিগ্রি পাস করেন এবং মিশনে শিশুদের গান শিখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ করতেন। এরপর তিনি কারিতাসের স্কুুলে প্রতিবন্ধী শিশুদের পড়ান।
২০২৩ সালে প্রাইমারি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিং করানো আরম্ভ করেন। সামাজিক সমস্যা সমাধানে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এলাকার নারীদের সংগঠিত করে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা জন্য এলাকায় তিনি আপোষহীন নেত্রী হিসেবে সুপরিচিত।
নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করা শ্রেষ্ঠ জয়িতা বিথি রানীঃ নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর গ্রামে নরেশ চন্দ্র ও চন্দনা রানীর ঘরে ১৯৯৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন বিথী রানী। তিন ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান বিধী রানী। জন্মের ৯ বছর পরে বাবা পরলোকগমন করেন এতে বিথীর পরিবারকে অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো। তাই প্রবল ইচ্ছা থাকার সত্ত্বেও বীথির মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি বেশিদূর লেখাপড়া করানোর। স্কুলে পড়াকালীন বান্ধবীরা সবাই মিলে তাকে টিফিনের সময় খাবার দিতো।
অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নত অবস্থায় মা এর সিদ্ধান্তে বিথিকে বিয়ের পীড়িতে বসতে হয়। বিয়ে হয় নওগাঁ জেলার পত্নীতলা উপজেলার আজমতপুর গ্রামের জিতেন হালদারের বড় ছেলে বীরেন হালদারের সাথে। প্রথমে দাম্পত্য জীবন ভালই কাটছিল দু’বছরের মাথায় ২০১৪ সালে ঘর আলো করে আসে এক পুত্র সন্তান। সন্তান জন্ম নেওয়ায় ধীরে ধীরে খরচ বেড়ে যেতে থাকে, তখন থেকে শুরু হয় স্বামী ও শাশুড়ি অমানবিক নির্যাতন।
এভাবে কোনদিন খেয়ে কোনদিন না খেয়ে আবার কোন দিন মানুষের বাড়িতে চেয়ে খেয়ে জীবনযাপন করতে হতো। বাচ্চার বয়স যখন চার থেকে পাঁচ বছর ঠিক তখনই হঠাৎ একদিন স্বামী শাশুড়ি মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রতিবেশী দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের নারী নেত্রী রিক্তা রানী বিথিকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়, সেখানে কিছুদিন থেকে সুস্থ হওয়ার পরে বিথি মায়ের বাড়িতে গেলে সেখানেও দাদা বৌদির সংসারে বৌদি সব সময়ই খোটা দিতে লাগে।
একদিন বিথি রাণী তার মা ও মামার সঙ্গে পরামর্শ করে নজিপুর ব্রাক অফিসে অভিযোগ দায়ের করলে, ব্রাক কর্তৃপক্ষ বিথি ও তার স্বামী উভয়কে ডেকে একটা মীমাংসা করে দেয়। স্বামীর সঙ্গে পুনরায় স্বামীর বাড়িতে চলে যায়, কিন্তু শাশুড়ি তাদেরকে ঘরে তোলে না ঠিক সেই মুহূর্তে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এর উজ্জ্বজীবক ও পত্নীতলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম, বিথি রাণী ও তার স্বামীকে থাকার জন্য একটা আশ্রয় করে দেন।
এভাবে বেশ কিছুদিন যাওয়ার পরে বিথির পরিবারে আরেক নতুন সদস্য কন্যা সন্তানের আগমন ঘটে এতে সংসারে খরচ বেড়ে যায়। বিথি রাণী আত্মনির্ভরশীল হতে স্কুল জীবনে শেখা নকশী কাঁথা সেলাইয়ের কাজকে কাজে লাগিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন ধরনের নকশি কাঁথা সেলাই করতে থাকে এতে মাসে প্রায় দেড় থেকে ২ হাজার টাকা ইনকাম হতে শুরু করে, এভাবে বেশ ভালোই দিন কাটতে থাকে।
২০১৭ সালে দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ এর সহায়তায় বিথি রাণী সহ ৩০ জন নারী মিলে একটি সংগঠন তৈরি করে, সেই সংগঠনে সঞ্চয়ের জন্য প্রতিমাসে ৫০ টাকা করে মাসিক চাঁদা নির্ধারণ করে সঞ্চয় শুরু করে তারপর কিছুদিন যাওয়ার পরে, উক্ত সংগঠন থেকে ৫০০০ টাকা উত্তোলন করে বিথি একটি ছাগল ক্রয় করে, সেই ছাগল থেকে দুই বছর পরে একটি গাভী ক্রয় করে, এভাবে হাঁস মুরগি পালন, বাড়ির আঙ্গিনা সবজি চাষ করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে। বর্তমানে সব মিলিয়ে প্রতিমাসে গড়ে ১৫হাজার টাকা ইনকাম করে বিথি রানী। এখন শশুর-শাশুড়ি ও পরিবার সকলেই তাকে সম্মান করে।
বিথি বলেন কয় বছর আগে আমি ছিলাম সকলের অবহেলার পাত্র, আজ আমি নিজেই প্রতিষ্ঠিত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরে নিজেকে নিয়ে খুব গর্ববোধ মনে করছি। তাই আমি সকল নারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই আমরা কোন নারী পরনির্ভরশীল থাকতে চাই না।
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখা শ্রেষ্ঠ জয়িতা প্রতিমা রাণীঃ মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যদিয়ে বয়স এখানে মূখ্য বিষয় নয় এটাই যেন প্রমাণ করেছেন পত্নীতলা উপজেলার মাটিন্দর ইউনিয়নের ওয়ারী গ্রামের নিতাই চন্দ্র ও রাণীর চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান প্রতিমা রানী।
একটু ভিন্ন প্রকৃতির কর্মচঞ্চল হাসিমাখা মুখের অধিকারী এই মেয়েটির বাল্যকাল কেটেছে চরম আর্থিক দৈন্যতায়। একমাত্র উপার্জনক্ষম বাবা সংসারের খরচ চালিয়ে চার সন্তানকে ঠিকমতো পড়াশুনা করাতে পারতো না। মেধাবী প্রতিমা রানী নিজের চেষ্টায় এবং তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু বক্কর সিদ্দিক-এর সহায়তায় শাশইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন।
এই সময় পরিবার এবং সমাজের লোকজন বিভিন্নভাবে তাকে লেখাপড়ার প্রতি নিরুৎসাহিত করতে থাকে। এমন অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভগিরথপুর গ্রামের নয়নের সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর শশুর-শাশুরী তার লেখাপড়ার উৎসাহ দেখে তাকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু অভাবের সংসার ও আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যে নিজের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সেলাই প্রশিক্ষন নিয়ে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন।
সেলাইয়ের কাজের পাশাপাশি গ্রামের অবহেলিত নারীদের সেলাই প্রশিক্ষন দিতে থাকেন। এতে করে নিজের পাশাপাশি গ্রামের অন্য নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। ২০২২ সালের ইউপি নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
এসময় সামাজিক কাজের অংশগ্রহণের সুবাদে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে নানাশ্রেনি পেশার মানুষের সাথে পরিচয়ের সুযোগ হয়। এদিকে সামাজিক সমস্যা সমাধানে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এলাকার নারীদের সংগঠিত করে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন, প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় প্রবেশের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা, মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে সচেতনতা সৃষ্টি, ভিক্ষুকদের পূর্ণবাসন, সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ সহ অসহায় দরিদ্র নারীদের ভাগ্য পরিবর্তনে তার ভূমিকা অসামান্য।
২০২৩ সালে হাঙ্গার প্রজেক্টের সঙ্গে জরিত হয়ে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে ইউনিয়ন ভিত্তিক সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে ক্ষুধামুক্ত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পদক্ষেপ গ্রহন করেন।
পরিবর্তনশীল সমাজ সম্পর্কে প্রতিমা রানীর ভাবনা পরিষ্কার। যে সমাজে সবাই শান্তিতে থাকবে, প্রতিটি ঘরে সুখ থাকবে এবং কাধে কাধ মিলিয়ে সবাই পাশাপাশি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তবে এখানে মানুষকে সমান ভাবে মূল্যায়ন করতে হবে।
ধনী-দরিদ্র কিংবা নারী পুরুষ আলাদা না রেখে সবাইকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন এবং সুষ্ঠু সমাজ প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে শিক্ষিত ও জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দিতে হবে। সর্বোপরি পাল্টাতে হবে নিজেকে, পাল্টাতে হবে নিজের মানসিকতাকে। তাই তিনি পাল্টিয়েছেন নিজেকে এবং নিজের মানসিকতাকে।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন