সিলেটে যৌথবাহিনীর অ্যাকশন শুরু: লাপাত্তা অস্ত্রধারীরা

সিলেটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরোধী পক্ষ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতাকে হঠাতে ভয়ংকর অস্ত্র হাতে নিয়ে সিলেটের শীর্ষ শ্রেণীর নেতাদের সাথে প্রথম সারিতে মিছিলে দেখা মিলেছিলো সেই সব অস্ত্রধারীরা।

পুলিশের পাশা পাশি ছাত্রদের উপর গুলিও করতে দেখা গেছে। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে শুরু হওয়া যৌথবাহিনীর অভিযানে ছাত্র জনতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের পাশাপাশি অস্ত্রধারীরা গ্রেফতারের প্রত্যাশা সচেতন সিলেটবাসীর।

জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে পিস্তল, শর্টগান, কাটারাইফেল থেকে শুরু করে ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগের সন্ত্রাসীরা ভয়ংকর স্নাইপার রাইফেলও ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠছে। অস্ত্রধারি সন্ত্রাসীদের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে ছররা গুলী, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের তথ্য থাকলেও প্রাণঘাতি বুলেট ব্যবহারের কথা স্বীকার করেনি কেউ। অথচ ছাত্র আন্দোলনে সিলেট নগরীতে গুলীবিদ্ধ হয়েছেন শতাধিক ছাত্র-জনতা। আওয়ামী সন্ত্রাসীদেও ছোড়া প্রাণঘাতি অস্ত্রের গুলীতে বুলেট বিদ্ধ হয়ে এখনো ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন অনেকেই।

এছাড়া সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হওয়ার সংখ্যা অর্ধশতাধিক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত ছাত্র আন্দোলনে সিলেটে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত অনেক অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে একটি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চলছে তোলপাড়। অস্ত্রটিকে কেউ বলছেন একে ফোরটি সেভেন। কেউ আবার এমআর সিক্সটিন, কেউ বা এটিকে বলছেন স্নাইপার। ভয়ঙ্কও সেই অস্ত্র। যেটি অতীতে কখনো সিলেটের রাজপথে কোন দিন দেখা যায়নি।

আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে সিলেটের রাজপথে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে অনেক বার। কিন্তু এত ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিয়ে অতীতে কখনোই কেউ প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে নামেন নি। কিন্তু এবার ২রা আগস্ট থেকে ৪ঠা আগস্ট পর্যন্ত সিলেটের রাজপথে ভয়ঙ্কর এসব অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে। আর এ অস্ত্রের ব্যবহারে চলে গেছে তাজা প্রাণ।

কেউ আবার আশঙ্কাজনক অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এই অস্ত্র বহন করেছিলেন শিপলু নামের একজন। পুরো নাম রুহুল আমীন। অনেকটা অপরিচিত এই শিপলু। আন্দোলনের সময় সিলেটের রাজপথে এই অস্ত্রের সঙ্গে শিপলুর নামটি আলোচিত হয়েছে। ইতিমধ্যে শিপলুকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
কে এই শিপলু- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে; শিপলু যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন।

ওখানে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর খুব কাছের লোক হিসেবে পরিচিত শিপলুর বাড়ী হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জে। গত ২০ শে জুলাই শিপলু সিলেটে আসেন। এরপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে রাজপথে নামেন।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে- সিলেটে এবার প্রথম অস্ত্রের মহড়া শুরু হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে। এরপর থেকে এই অস্ত্রের ঝনঝনানি ছড়িয়ে পড়ে সিলেট নগরীর সর্বত্র। এমনকি পাহারা মহল্লায় ব্যবহৃত হয় আগ্নেয়াস্ত্র।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেটে প্রথমে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক আন্দোলন শুরু হওয়ার কারণে শাবি শিক্ষার্থীদের ওপর ধারালো অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়। পরে আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ কর্মীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলের সি ব্লকের ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অমিত শাহ’র ৪২৩ নম্বর রুম থেকে দুটি পিস্তল সাধারণ শিক্ষার্থীরাই খুঁজে বের করে।

এরপর ২ আগস্ট থেকে শাবি ফটক ও মদিনা মার্কেট এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে সিলেটের যুবলীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা প্রকাশ্য অস্ত্র প্রদর্শন শুরু করে। ৩ আগস্ট পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়ায় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুদ্র সেন পানি ডুবে মারা যায়, সে দিন পুলিশকে পেছনে রেখে ফ্রন্টলাইনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে সুরমা আবাসিক এলাকায় অনবরত গুলি ছুঁড়ে।

গুলির শব্দে ওই দিন সুরমা আবাসিক এলাকা প্রকম্পিত হয়। এর আগে ২ আগস্ট ও পরে ৪ঠা আগস্টও এসব এলাকায় গুলিবর্ষণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মদিনা মার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পর্যন্ত নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও সাবেক কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, তার সশস্ত্র ক্যাডার আজহার উদ্দিন সুমন, পাঙাস ও তুহিনের নেতৃত্বে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এদিন সুবিদবাজার এলাকার বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান ওরফে মুরগি হান্নানের নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র ক্যাডাররা মাঠে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গুলি ছুঁড়ে।

পুলিশ যখন ছাত্র বিক্ষোভ দমাতে ক্লান্ত তখনই এই সব অস্ত্রবাজরা পুলিশের প্রক্সি হিসেবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে নামে। এতে ওই এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন অগনিত শিক্ষার্থী।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ৪ আগস্ট। সে দিন সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টা এলাকায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলীবর্ষণের ঘটনা ঘটে। এমনকি সে দিন উপ পুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ, সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া হয়।

৩ আগস্ট ঘোষণা দিয়ে পরদিন ৪ আগস্ট নগরী কোর্ট পয়েন্টে বেলা ১১টার পর অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তখন সিলেট বিএনপিসহ বিরোধী বলয়ের কর্মীরাও সেখানে জড়ো হন। দুপুরের দিকে পুলিশ অ্যাকশনে গিয়ে ওই এলাকায় তাদের সরিয়ে দিলে রাজপথ দখলে নেয় আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে সিলেট আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডাররা অস্ত্র নিয়ে মহড়া শুরু করে।

এ সময় দফায়-দফায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। আর এ সময় ঐসব এলাকায় শত-শত রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর এ সময় রুহুল আমীন শিপলুর মরণঘাতি ভয়ানক অস্ত্রের বিষয়টি প্রকাশিত হয়। এছাড়া এই সময় আফতাব, জাহাঙ্গীর, দেবাংশু দাস মিঠু, আব্দুল আলীম তুষার ও আব্দুল হান্নান দলবল নিয়ে কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, চৌহাট্টাসহ নগরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিলো।

এর বাইরে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি পীযূষ কান্তি দে তার দলবল দিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। পীযূষের সঙ্গে থাকা তার এক সহযোগীর হাতে ছিল তার সেই বহুল আলোচিত দু’নলা বন্দুক। এ ছাড়া শটগান হাতে যুবলীগ নেতা জাহেদ, মুনিম অখিলি, সজল দাশ অনিক, শান্ত, টিলাগড়ের ভয়ঙ্কর আলোচিত অস্ত্রধারী আনসার, এমসি কলেজের দেলোয়ার হোসেন রাহী, সরকারি কলেজের রুহেল আহমদ, রাজন আহমদ, ছাত্রলীগের তানভীর, সৈকত চন্দ্র রিমী, গৌরাঙ্গ দাশ সশস্ত্র অবস্থায় ছিল। তারা ওইদিন গুলিবর্ষণ করে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

এদিকে শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের দিন (৫ আগস্ট) সিলেটসহ সারাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি থানায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অস্ত্র লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এসব অস্ত্র ফিওে পেতে মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় অন্তর্বরতী সরকার। এছাড়া বেসামরিক লোকজনকে দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স গত ২৫ আগস্ট স্থগিত করে বর্তমান সরকার। এসব অস্ত্রও জমা দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত তারিখ নির্ধারণ কওে দেয়া হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত এসব সব অস্ত্র ফিরে না পাওয়ায় বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) থেকে সারাদেশে যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সতর্ক করে সোম ও মঙ্গলবার সিলেটজুড়ে মাইকিং করা হয়।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) সূত্রে জানা গেছে, বুধবার থেকে সারাদেশের ন্যায় সিলেটেও অভিযানে নামছে যৌথবাহিনী। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার ব্যাটালিয়ানের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করবে। সিলেট মহানগর এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযানে নেতৃত্ব দিবেন সেনাবাহিনীর লে. কর্ণেল আলিফ।

এ ব্যাপারে এসএমপির মিডিয়া কর্মকর্তা উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারী থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের দেয়া সকল বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে অন্তর্বরতীকালিন সরকার। এছাড়া ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সিলেট নগরীর বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

এসময় নগরীর ৬টি থানায় ১০১টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র মিসিং ছিল। এরমধ্যে ৮০ টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ২১ টি এখনো উদ্ধার হয়নি। এছাড়া এসএমপির এলাকায় লাইসেন্স করা ২৪৬টি অস্ত্রের মধ্যে শতাধিক অস্ত্র জমা হয়েছে। যেসব অস্ত্র জমা হয়নি সেগুলোকে অবৈধ অস্ত্র বিবেচনায় তা উদ্ধারে অভিযান চলবে।

এছাড়াও উক্ত অভিযানে বিগত সময়ে ব্যবহৃত সবধরণের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হবে। এ ব্যাপারে আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে বলেও জানান তিনি।