সুন্দরবনের লোভনীয় বুনো ফল কেওড়া
সুন্দরবনঘেঁষা খুলনার কয়রা উপজেলা। পাশেই বইছে শাকবাড়িয়া নদী। সেখানকার গ্রামীণ মেঠো পথে হাঁটলে শুনতে পাবেন পাখির কিচিরমিচির শব্দ। নাকে এসে বাড়ি খাবে মিষ্টি এক ঘ্রাণ। নদীর তীর ধরে দেখতে পাবেন সারি সারি কেওড়াগাছ। ঘন সবুজ ওড়াবনে ছেয়ে আছে চারপাশ।
পরিকল্পিত বনায়ন নয়; বরং প্রকৃতির অবারিত দানে বেড়ে উঠেছে এসব কেওড়াবন। স্থানীয় লোকেরা বলছেন, নদীর ওপারে সুন্দরবন। জোয়ারের সময় সুন্দরবন থেকে ভেসে আসে কেওড়া ফল। সেসব ফল চরে আটকে যায়। তা থেকেই অঙ্কুরিত হয় কেওড়াগাছ। সবুজ গাছ ভরে ওঠে মিষ্টি সুবাসিত ফুলে। জন্মায় উপাদেয় কেওড়া ফল।
সুন্দরবনে যেসব গাছ বেশি দেখা যায়, তার মধ্যে কেওড়া অন্যতম। সুন্দরবনের নদী–খালের পাড়ে, চরের জৈববর্জ্যযুক্ত ও লবণাক্ত মাটিতে এই গাছ বেড়ে ওঠে। বৈজ্ঞানিক নাম Sonneratia apetala। একেকটি কেওড়াগাছ লম্বায় প্রায় ২০ মিটার হয়ে থাকে। পাতা সরু ও লম্বাটে। অনেকটা তেজপাতার মতো দেখতে।
কেওড়াগাছে হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল হয়। দারুণ মিষ্টি একটি সুবাস রয়েছে এ ফুলের। ফলও হয় প্রচুর। কেওড়া ফল দেখতে গোলাকার, অনেকটা ডুমুরের মতো। সবুজ রঙের ফলের ওপরের মাংসল অংশ টক স্বাদের। ভেতরে বেশ বড় বীজ। সাধারণত ফাল্গুনে কেওড়াগাছে ফুল ফোটে আর চৈত্র-বৈশাখে ফল ধরে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত কেওড়া ফল পাওয়া যায়।
কেওড়া ফল সুন্দরবনের হরিণ ও বানরের কাছে বেশ লোভনীয় একটি খাবার। বহু আগে থেকে মানুষও এই ফল পাতে তুলেছে। তবে সুন্দরবন–সংলগ্ন এলাকার মানুষ কেওড়া ফল বেশি খান। অন্য স্থানে এটা খাওয়ার খুব একটা প্রচলন নেই। সুন্দরবনে উত্পন্ন মধুর একটি বড় অংশ আসে কেওড়া ফুল থেকে। অন্যদিকে কাঁচা কেওড়া ফল লবণ মেখে খাওয়া যায়। এ ফল দিয়ে বানানো কেওড়াজল বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করা হয়।
কাঁচা খাওয়ার পাশপাশি এ ফলের সঙ্গে চিংড়ি ও মসুরের ডাল মিশিয়ে বিশেষ একটি পদ রান্না করা হয়। কেওড়া ফল থেকে বানানো যায় আচার ও চাটনি। কেওড়া ফল পচে গেলে তা মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ জুলফিকার হোসেনের সুন্দরবনের বুনো ফুল–ফল নিয়ে একটি গবেষণা রয়েছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সেলের উদ্যোগে এই গবেষণা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেওড়া শুধু উপাদেয় নয়; পুষ্টিগুণে ভরা একটি ফল। এই ফলে রয়েছে ১২ শতাংশ শর্করা, ৪ শতাংশ আমিষ, ১.৫ শতাংশ চর্বি।
ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ কেওড়া ফল মানুষের শরীর ও মনকে সতেজ রাখে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। রক্তে কোলেস্টেরল ও শরীরের চর্বি (ফ্যাট) কমায়। এর কিছু এনজাইম বদহজম, আমাশয় ও পুরোনো ব্যথা দূর করে। এই ফলে আপেল ও কমলার চেয়ে বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে।
শিল্পেও কেওড়া ফলের গুরুত্ব রয়েছে। এতে প্রচুর পালমিটিক অ্যাসিড, অ্যাস্করবাইল পালমিটেট এবং স্টিয়ারিক অ্যাসিড রয়েছে, যা খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ ও তৈরি খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার করা হয়। তাই কেওড়া ফলের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ালে নানা রকম লাভ পাওয়া যাবে।
কয়রার হাটে–বাজারে এক কেজি কেওড়া ফল ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র মানুষের বাড়তি আয়ের পথ খুলে দিতে পারে এই ফল। গবেষকেরা বলছেন, এজন্য উপকূলের লবণাক্ত জলাভূমিতে কেওড়া চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। এই উদ্যোগে স্থানীয় প্রান্তিক মানুষদের সম্পৃক্ত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিতে অগ্রগতি অর্জিত হবে, তেমনি পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের আয় বাড়বে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন