সুন্দরবনে জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যস্ত বনজীবীরা

টানা তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার পর আগামী রোববার থেকে বনজীবী ও পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে সুন্দরবন। দীর্ঘ বিরতির পর সুন্দরবনের ভেতরে মাছ ও কাঁকড়া ধরতে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে খুলনার সুন্দরবন–সংলগ্ন বনজীবী পরিবারগুলোতে।

দীর্ঘদিন পর আয়-রোজগারের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক পেশাজীবীদের মধ্য স্বস্তি ফিরে এসেছে। কেউ নতুন করে জাল বুনছেন, কেউ পুরোনো জাল মেরামত করছেন। আবার কোথাও চলছে নৌকা-ট্রলার প্রস্তুতের শেষ মুহূর্তের কাজ।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গকিলোমিটার; যা পুরো সুন্দরবনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সুন্দরবনের জলভাগে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে গত ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ। রবিবার থেকে সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।

সুন্দরবন–সংলগ্ন কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীপারের হরিহরপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, জেলে নৌকাগুলো নদীর তীরে সার করে বাঁধা। অনেকেই শেষবারের মতো নৌকা ও মাছ ধরার ছেঁড়া জাল মেরামতের কাজ করছেন। এখন তাঁরা সুন্দরবনে গিয়ে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ কেনার টাকা জোগাড়ের কাজে ব্যস্ত। অনেক জেলেই চড়া সুদে টাকা নিচ্ছেন কারবারিদের কাছ থেকে। কেউবা এনজিও ও বিভিন্ন সমিতি থেকে ঋণ করছেন।

হরিহরপুর এলাকার বনজীবী জেলে গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, ‘তিন মাস বনে ঢুকতে পারিনি। এই সময়ে অন্য কোনো কাজ ছিল না। সরকারেরও পরিবর্তন হইছে। আগের সরকারের সময় সুন্দরবনের জেলেদের কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। মহাজনদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ সুদেও টাকা নিয়েছে অনেকে। খুব কষ্টে কেটেছে। রোববার থেকে সবাই বনে যেতে পারব। আমার নৌকা, জাল মেরামতের কাজ শেষ করেছি।’ এখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে মাছ ও কাঁকড়া ধরে ঋণ পরিশোধের আশা তাঁর।

জুন থেকে আগস্ট—এই তিন মাস প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবনের নদী ও খালে থাকা বেশির ভাগ মাছ ডিম ছাড়ে। এ কারণে গত ১ জুন থেকে তিন মাসের জন্য জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বন বিভাগ।

সুন্দরবন–সংলগ্ন জোড়শিং এলাকার বনজীবী আসাদুল ইসলাম সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য নৌকা মেরামত করছিলেন। কাজের ফাঁকে তিনি জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল কোনো লোক সুন্দরবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যান না। যাঁরা যান, তাঁরা প্রায় সবাই দরিদ্র। এই তিন মাস নিষেধাজ্ঞার সময় সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল মানুষেরা বেকার থাকেন। তাঁদের জন্য কোনো সুবিধা দেওয়া হয় না।

আসাদুল ইসলাম আরও জানান, সুন্দরবনের একেকটি নৌকায় দু–তিনজন জেলে থাকেন। নৌকার জেলেরা সাত দিনের জ্বালানি, খাদ্য, পানি, মাছ সংরক্ষণের বরফসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে ছোটেন সুন্দরবনে মাছ শিকারের জন্য।

শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধের ওপর জাল বুনতে বুনতে জেলে কামরুল ইসলাম বলেন, বিকল্প কোনো কাজের সুযোগ না থাকায় ধারদেনা করে হলেও সুন্দরবনের এ অনিশ্চিত যাত্রায় ছুটতে হয় তাঁদের। তিনি জানান, জাল মেরামত শেষ পর্যায়ে। এখন শুধু সুন্দরবনে ঢোকার জন্য অপেক্ষা। আগেভাগে সুন্দরবনে ঢুকতে পারলে মাছ বেশি পাওয়া যায়। এ জন্য ১ সেপ্টেম্বর প্রথম দিনেই তিনি সুন্দরবনে ঢুকবেন।

তবে জেলেদের অভিযোগ, বন বিভাগ যে উদ্দেশ্যে সুন্দরবনে প্রবেশের তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, তা সফল হয়নি। কারণ, প্রজনন মৌসুমে মাছ, কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ হলেও তা উপেক্ষা করে অসাধু জেলেরা বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে বিষ ছিটিয়ে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করছেন। এতে প্রকৃত জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তাঁরা।

বন বিভাগ সূত্রে আরো জানা গেছে, সুন্দরবনে সম্পদ আহরণের জন্য ১২ হাজার নৌকা ও ট্রলারকে বোর্ড লাইসেন্স সার্টিফিকেট (বিএলসি) দেওয়া হয়। এসব নৌযানের মাধ্যমে প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করেন। এ ছাড়া সুন্দরবনের ৭টি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে প্রতিবছর আড়াই লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন।

কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কয়রায় নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ১৩ হাজার ৫২৬ জন। অবশ্য স্থানীয় বনজীবীরা বলছেন, কয়রায় জেলেদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্য নয়, মৎস্য সম্পদেরও আধার। ১ সেপ্টেম্বর থেকে জেলে ও পর্যটকদের সুন্দরবনে ঢোকার পাস (অনুমতি) দেওয়া হবে। নির্ধারিত ফরেস্ট স্টেশনগুলোকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আগে থেকে জেলে–বাওয়ালিরাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অনুমতিপত্রের মেয়াদ অনুযায়ী, জেলেরা সুন্দরবনে অবস্থানকারী জেলেদের তালিকা বনরক্ষীদের ক্যাম্প কর্মকর্তার কাছেও থাকবে। বনরক্ষীরা তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি খালে টহল দিয়ে অনুমোদন পাওয়া জেলের নৌকা যাচাই করে দেখবেন।