সূর্যগ্রহণের নামাজ ও করণীয়
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ঘটবে আজ। এ সূর্যগ্রহণ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার একটি মাধ্যম। তা কোনো আনন্দ-কৌতুলহলের বিষয় নয়; বরং এ সময়টিকে ভয় করা বিশ্বনবির সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যগ্রহণের পুরো সময়টিতে নামাজ পড়তেন। ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। সে কারণেই সূর্যগ্রহণের সময় নামাজ ও করণীয় সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি।
১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭.৩৪ ঘটিকায় শুরু হবে এবারের পূর্ণ সূর্যগ্রহণ। ফলে তা বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে না বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। তবে এ সময়টিতে হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী মুমিন মুসলমানের ভয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করা সুন্নাত। এ সম্পর্কিত হাদিসের নির্দেশনা হলো-
– হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় একবার সূর্যগ্রহণ শুরু হলো। সে সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্রুত মাসজিদে গেলেন এবং সবাইকে মাসজিদে আসার আহবান জানালেন। তিনি নামাজে দাঁড়ালেন এবং নামাজ এত দীর্ঘ করলেন যে জামাআতে আগে কখনো তিনি এমন করেননি। নামাজের ধারাবাহিকতা ছিল এমন-
অতপর রুকূতে গেলেন এবং রুকূ এত দীর্ঘ করলেন যা আগে কখনো করেননি।
অতপর সিজদায় না গিয়ে আবার দাঁড়ালেন এবং দ্বিতীয় রাকাআতেও কেরাত দীর্ঘ করলেন।
অতপর আবার তিনি রুকূতে গেলেন এবং তা আগের রুকুর চেয়ে আরও দীর্ঘ করলেন।
রুকূ শেষে দাঁড়ালেন এবং তারপর সিজদায় গেলেন এবং তা (সিজদা) এত দীর্ঘ করলেন যে, আগে কখনো এমন করেননি।
অতপর সিজদা থেকে দাঁড়িয়ে প্রথম দুই রাকাআতের ন্যায় দ্বিতীয়বারও ঠিক একইভাবে নামাজ আদায় করলেন। ততক্ষণে সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে যায়।
নামাজ শেষ হলে তিনি আল্লাহর হামদ (প্রশংসা) পেশ করে খুতবা দিয়ে বললেন-
‘সূর্য এবং চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শন সমূহের মধ্যে দু’টি নিদর্শন। কারোর মৃত্যু কিংবা জন্মগ্রহণের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। অতএব, যখনই তোমরা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ দেখবে তখনই আল্লাহকে ডাকবে, তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করবে এবং নামাজে রত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সূর্যগ্রহণে বিশ্বনবি যা করতে বলেছেন
যখন সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ শুরু হতো তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে জামাআতে নামাজ পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে যেতেন। আল্লাহর কাছে প্রচণ্ড রোনাজারি করতেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন তিনি। আল্লাহ তাআলা সুরা বনি ইসরাইলের এ ভয়ের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন-
وَمَا نُرْسِلُ بِالاٌّيَاتِ إِلاَّ تَخْوِيفًا
অর্থাৎ আর আমি ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই নিদর্শনাবলি প্রেরণ করি।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : আয়াত ৫৯)
হজরত আবু মুসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় একবার সূর্যগ্রহণ লাগল। তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি কেয়ামত হওয়ার আশঙ্কা করছিলেন। অবশেষে তিনি মসজিদে এসে নামাজে দাঁড়ালেন এবং সবচেয়ে লম্বা কেয়াম(দীর্ঘক্ষণ কেরাত পড়া), লম্বা রুকূ, লম্বা সেজদাসহ নামাজ আদায় করতে লাগলেন। আমি কখনও কোনো নামাজে তাঁকে এত লম্বা করতে দেখিনি। নামাজ শেষ করে তিনি বললেন, ‘এসব নিদর্শনাবলী যা আল্লাহ জগতে পাঠান, কোনো ব্যক্তির মৃত্যু বা জীবনের কারণে অবশ্যই তা হয় না। বরং আল্লাহ এগুলো পাঠিয়ে বান্দাদের সতর্ক করেন। সুতরাং যখন এমন কিছু দেখতে পাও, তখন তোমাদের করণীয়-
>> তোমরা ভীত হয়ে আল্লাহর জিকির কর;
>> আল্লাহর কাছে দোয়া কর;
>> আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনায় রত হও।’ (মুসলিম)
– হজরত আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘একবার আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে থাকাকালে সূর্য গ্রহণ শুরু হলো। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং পরিহিত চাদর টানতে টানতে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তাঁর সঙ্গে আমরাও প্রবেশ করলাম। তিনি আমাদের নিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করলেন এবং সূর্যগ্রহণ ছেড়ে গেলো। তিনি বললেন এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কারো মৃত্যুর কারণে কখনও সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন (চন্দ্র-সূর্য) গ্রহণ দেখবে তখন তা থাকা অবস্থা পর্যন্ত সালাত আদায় করবে এবং দোয়ায় মগ্ন থাকবে।’ (বুখারি)
সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বিজ্ঞানের গবেষণা ও ইসলাম
বিশ্বনবির সময়ে সূর্যগ্রহণ হলে বিশ্বনবি যখন নামাজ পড়তেন এবং পৃথিবী ধ্বংসের ভয় করতেন, তখন সে সময়ের অবিশ্বাসী বিজ্ঞানীরা তাকে কটাক্ষ করেছিল এবং হাসি-বিদ্রুপ করেছিল। তাদের প্রশ্ন ছিল- নামাজ, ভয় কিংবা কান্নার প্রয়োজনীয়তা কি?
কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় তা সুস্পষ্ট যে,রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কান্না, ভয়, নামাজ, ক্ষমা প্রার্থনা সবই যুক্তিযুক্ত ও সঠিক ছিল। সূর্যগ্রহণের সময়ের এ আমলের কারণও প্রকাশিত হলো। তাহলো- ‘সূর্যগ্রহণের ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।’
হাদিসের ভাষ্য ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফল হলো, সূর্যগ্রহণ লাগলে মুমিন মুসলমান এর ক্ষতি থেকে বাঁচতে আবশ্যক করণীয় হলো-
>> বেশি বেশি দোয়া করা,
>> তাসবিহ পাঠ করা,
>> তাওবা-ইসতেগফার করা,
>> লম্বা কেরাতে নামাজ আদায় করা এবং
>> যাবতীয় বিপদাপদ থেকে বাঁচতে দান-সাদকা করা।
কেননা হাদিসে এসেছে, নামাজ, দোয়া, ভয়, দান-সাদকা ও তাওবা ইসতেগফার দ্বারা আল্লাহ বান্দাকে ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। তাছাড়া সূর্যগ্রহণ যেহেতু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট পরীক্ষা। তাই আল্লাহর প্রকৃত বান্দারা এ সময় আল্লাহর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকেন। হাদিসে পাকেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ আমলগুলো প্রমাণিত।
নামাজ পড়ার নিয়ম
সূর্যগ্রহণের নামাজ ২ রাকাআত। সূর্যগ্রহণ চলাকালীন সময় পর্যন্ত এ নামাজ পড়া সুন্নাত। অন্য সাধারণ নামাজের মতই এই নামাজ আদায় করতে হয়। যদিও প্রতি রাকাআত অনেক দীর্ঘ করে পড়তে হয়। তবে প্রত্যেক রাকাআতে ২ রুকু, ৩ রুকু বা ৪ রুকু আদায়ের এক ব্যতিক্রমী নিয়মে নামাজ পাড়ার বিবরণও বর্ণিত হয়েছে। তবে এ নামাজের কোনো আজান ও ইকামত নেই। মাকরূহ ওয়াক্ত ব্যতিত মসজিদে জামাআতের সঙ্গে এই নামাজ আদায় করা সুন্নাত।
নারীদের করণীয়
নারীরাও সূর্যগ্রহণের সময় ঘরে একাকি নামাজ আদায় করবেন। নামাজ শেষে জিকির, দোয়া, তাওবা-ইসতেগফা, দান-সাদকার মাধ্যমে কাটানো উত্তম। তবে গর্ভবর্তী নারীদের জন্য যেসব কথা বা গালগল্প প্রচলিত আছে তা কুসংস্কার।
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, সূর্যগ্রহণের সময় অনর্থক গল্প-গুজব, হাসি-তামাশা ছেড়ে নামাজ পড়া, অন্তরে ভয় জাগ্রত রাখা, তাওবাহ-ইসতেগফার করা আবশ্যক।
উল্লেখ্য, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ঘটবে সোমবার (১৪ ডিসেম্বর)। তা বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে না। বাংলাদেশ সময় সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ৩৪ মিনিটে তা শুরু হবে। কেন্দ্রীয় গ্রহণ শুরু রাত ৮টা ৩২ মিনিটে, সর্বোচ্চ গ্রহণ রাত ১০টা ১৩ মিনিটে, কেন্দ্রীয় গ্রহণ শেষ হবে রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে এবং সর্বোচ্চ শেষ হবে রাত ১২টা ৫৩ মিনিটে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসের উপর আমল করার তাওফিক দান করুন। সূর্যগ্রহণের ক্ষতি থেকে হেফাজত রাখুন। আমিন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন