হাজারো রোহিঙ্গা নারী জন্ম দেবে ‘অপ্রত্যাশিত শিশু’
মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের দ্বারা ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার শিকার হওয়া হাজারো রোহিঙ্গা নারী জন্ম দিতে শুরু করেছেন ‘অপ্রত্যাশিত শিশু’।
বাংলাদেশের দিকে বড় আকারে রোহিঙ্গা ঢল নামার ৯ মাস পার হতে চলছে। ফলে সে সময় রাখাইনে ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের গর্ভের সন্তান জন্ম নেয়াও শুরু করেছে। এমন সন্তানসম্ভবা রোহিঙ্গাদের অধিকাংশেরই বয়স আঠারোর নিচে। আগামী কয়েক মাসে সন্তান প্রসবের এই হার আরও বাড়বে বলে জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।
সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য মতে, চলতি মাস থেকে আগামী কয়েক মাসে ধর্ষণের শিকার রোহিঙ্গা নারীদের পরিত্যক্ত সন্তানের সংখ্যা বেড়ে যাবে। হাজারো রোহিঙ্গা নারীর সন্তান প্রসবের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা রাখাইনে তারা যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য কর্মসূচি পরিচালনা করছে ফ্রান্সভিত্তিক চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)। সংস্থাটি সন্তানসম্ভবা রোহিঙ্গা হাজারো নারীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব মায়েদের অধিকাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। রাখাইনে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণের ফলে সামাজিক কলঙ্কের চিন্তা তাদের মানসিক পীড়ন অবর্ণনীয়ভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো বলছে, ধর্ষণের ফলাফল হিসেবে জন্ম নেওয়া এসব শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট ঝুঁকি আছে। প্রথমত এসব শিশুরা রোহিঙ্গা নারীদের লোমহর্ষক নির্যাতনের দিনগুলো মনে করিয়ে দেবে। পাশাপাশি এসব শিশুরা পরিচয় সংকটের কারণে বেড়ে ওঠার ঝুঁকিতে পড়বে। এরইমধ্যে অনেক ধর্ষণের শিকার অনেক রোহিঙ্গা নারী গর্ভপাত ঘটিয়ে সন্তান নষ্ট করেছেন।
সম্প্রতি সন্তান জন্ম দিয়েছেন এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ান। ‘আ’ আদ্যক্ষরের এক রোহিঙ্গা নারী কথা উঠে এসেছে তাদের প্রতিবেদনে। তার স্বামীর মৃত্যু হয়ে ২০১২ সালে।
ওই নারী বলেন, ‘এ নোংরা ঘটনার শিকার হওয়ার পর প্রায়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। লোকলজ্জার ভয়ে এটা (ধর্ষণের ঘটনা) প্রতিবেশীদের কাছ থেকে গোপন রাখারও চেষ্টা করি। কিন্তু শারীরিক পরিবর্তন দেখে প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে।’
বালুখালির পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা ক্যাম্পের ত্রিপলের ভেতর বসে এই রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘সেনারা যখন গ্রামে হানা দেয়, তখন তারা নারীদের ধর্ষণ করে এটা সবাই জানে। মংডু শহরে সহিংসতার সময় মিয়ানমারের তিন সেনা আমার ঘরে প্রবেশ করে। সেসময় সেনারা আমার পাঁচ সন্তানকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ধর্ষণ করে।’
ধর্ষণের শিকার হয়ে গ্রামের এক চিকিৎসকের কাছ থেকে তিনি ওষুধ কিনে খেয়েছিলেন। সে ওষুধ খাওয়ার পরেও তার গর্ভপাত হয়নি ৩৪ বছর বয়সী ওই নারীর। ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে যখন নতুন করে সেনারা নিপীড়ন শুরু করে তখন তিনি যখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী।
এ সময় লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বাংলাদেশে আসার পর আরেকবার গর্ভপাতের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনেক বেশি দেরি হয়ে যাওয়ায় এবং গর্ভপাতের অবৈধ প্রক্রিয়ায় জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে চিকিৎসকরা তাকে হুঁশিয়ারি করে দেন।
তিনি বলেন, ‘একজন বিধবা হিসেবে সমাজের কাছে গর্ভপাতের জন্য সাহায্য চাওয়া অনেক কঠিন। এক পর্যায়ে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হওয়ার অন্য উপায় খোঁজাও বন্ধ করে দিই। এখন আমি সবকিছুই আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।’
ওই নারী ২৬ জানুয়ারি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। শিশুটির জন্মের পর পরিবার ও সমাজে বিভক্তি দেখা দেয়। তিনি তার বাকি সন্তানকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, সে তাদের মতোই অন্যায়ের শিকার। নৃশংসতার প্রতিফলন হিসেবে যে শিশুটি পৃথিবীতে এসেছে তাকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না। শিশুটির তো কোনও দোষ নেই।
২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে রাখাইন রাজ্যে এমন ঘটনা অহরহ ঘটে আসছে। গর্ভপাত ছাড়া রোহিঙ্গা নারীদের স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আয়েশার মতো এমন আরও কত নারী কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে রয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও জানা নেই।
এমএসএফের তথ্য মতে, ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২৪ জন রোহিঙ্গা নারীকে তারা চিকিৎসা দিয়েছে, যারা রাখাইনে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তবে এমন হাজারো নারী আছেন, যারা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েও সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে সাহায্য নিতে আসেননি। জানুয়ারিতে এমএসএফের হাসপাতালে এমন বহু নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা গেছে। এসব নারীরা বাসায় গর্ভপাতের চেষ্টা চালিয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে বলে জাতিসংঘের যৌন সহিংসতা বিষয়ক বিশেষ দূত প্রমিলা পাতেন জানিয়েছেন। তার মতে, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎপাটন করতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগিয়েছে।
জাতিসংঘ রাখাইনে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়ে আসছে। এমনকি সংস্থাটি যৌন সহিংসতা চালানোর দায়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে গত এপ্রিলে জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত করেছে। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রাখাইনে ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করলেও প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্ত সেনাদের বিচার করা হবে বলে জানান।
কো কো লিন নামের একজন রোহিঙ্গা অ্যাকটিভিস্ট বলেন, ‘এমন ১৫ জন রোহিঙ্গা নারীকে আমি চিনি যাদের গত আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করে। বাস্তবে এমন নারীর সংখ্যা অনেক। এরকম আরও বহু ঘটনা অজানা রয়ে গেছে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, রোহিঙ্গা নারীদের দুই তৃতীয়াংশ রাখাইনে যৌন সহিংসতার শিকার হলেও লজ্জা ও কলঙ্কের কথা ভেবে কর্তৃপক্ষ কিংবা দাতব্য সংস্থার কাছে তারা তা জানাননি।
এমএএসএফের ডাক্তারদের সঙ্গে কাজ করা মেডিকেল সমন্বয়কারী মেলিসা হ জানান, ‘তারা তাদের নতুন বাচ্চার যত্ন নেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। তাদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এছাড়া সামাজিক লজ্জা ও কলঙ্কের কারণে অতিরিক্ত চাপে থাকে তারা। এসব নারীদের বেশিরভাগই প্রথম সন্তান প্রসব করবেন। অনেক নারীই ইতোমধ্যে সন্তান প্রসব করেছেন। বাকিদের আগামী সপ্তাহ থেকে সন্তান প্রসব শুরু হবে।’
এসব ‘অপ্রত্যাশিত শিশু’র পরিচয় সম্পর্কে রোহিঙ্গা অ্যাকটিভিস্ট লিন বলেন, ‘যেহেতু তারা রোহিঙ্গা নারীর গর্ভে বেড়ে উঠছে এবং এর জন্য সমস্ত কষ্ট ভোগ করছে রোহিঙ্গা নারীরা, তাই বাচ্চাটিও অবশ্যই রোহিঙ্গা বলে বিবেচিত হবে।’
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার সরকার। সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চার দশক ধরে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত হামলার অভিযোগ তুলে সেনা অভিযানের নামে নৃশংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত খুঁজে পেয়েছে বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’বলেও আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সমস্ত অভিযোগই বরাবরের মতো অস্বীকার করে আসছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন