হাতে স্যালাইনের সুচ তবু প্রাণের দাবিতে অনশন

“শিক্ষাগুরু বসে আছে ঢাকারো শহরে”, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্যের হতাশার গান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে। হতাশা দূর করতে এবং বৈষম্য নিরসনের গানে-স্লোগানে দ্বিতীয় দিনের মত অনশন করছেন প্রাথমিকের সহকারি শিক্ষকরা। শহীদ মিনারের কোলে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে-বসে আছেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষকরা।

ভিড়ের মাঝে দেখা যায় সাদা পাজামা-পাঞ্জাবীতে শুয়ে আছেন এক শিক্ষক। তার হাতের শিরায় স্যালাইনের সুচ, স্যালাইনের অর্ধেকটা বাকি আছে তাই সেটা একটু উঁচু করে ধরে পাশেই বসে আছেন আরেক শিক্ষক। অনশন করতে কিশোরগঞ্জের তারাইল থেকে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এমদাদুল হক নামের এই শিক্ষক।

সঙ্গে নিয়ে আসা ব্যাগের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থেকে পঞ্চাশোর্ধ এই শিক্ষক বলেন: এই বয়সেও শুধু বৈষম্য দূর করার প্রাণের দাবিতে এখানে এসে না খেয়ে আছি। বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয়করণ করেছিলেন তখন আমরা একই গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। ক্রমে ক্রমে বৈষম্য বেড়েছে, তিন থেকে চার ধাপে পৌঁছে গেছে। আমরা এই বৈষম্যের নিরসন চাই।

এই শিক্ষকের মতো অসুস্থ অবস্থাতেও অনশন না ভেঙে এখানে অবস্থান করছেন কয়েকজন শিক্ষক। বৈষম্য দূর না হলে যাবেন না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো.শামসুদ্দিন।

অনশনের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে এই শিক্ষক নেতা বলেন: ২০০৬ সালেও আমরা প্রধান শিক্ষকের একধাপ নিচে বেতন পেতাম। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন জাতীয়করণ করেছিলেন তখন প্রধান শিক্ষক-সহকারি শিক্ষকের মধ্যে বেতন বৈষম্য ছিলো না। বর্তমানে আমাদের মধ্যে তিন গ্রেড পার্থক্য। টাকার অংকে শুধু বেসিকেই পার্থক্য ২ হাজার ৩’শ টাকা। সব মিলিয়ে শুরুতেই আমাদের পার্থক্য দাঁড়ায় ৬-৭ হাজার টাকা। ১৬ বছর পর প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে একজন সহকারি শিক্ষকের বেতন পার্থক্য হবে ১৬-২০ হাজার টাকা। প্রধান শিক্ষকরা ১১ হাজার ৩’শ স্কেলে চাকরিতে যোগদান করেন। আর আমরা ১১ হাজার ৩’শ টাকা বেতনে চাকরি শেষ করি। অর্থাৎ আমাদের শেষ তাদের শুরু।

বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক মহাজোটের
তুলে ধরা বৈষম্যের চিত্র

কুমিল্লা থেকে অনশনে যোগ দিতে এসেছেন লুৎফুনন্নাহার লিপি। দাবি আদায়ের এই অনশন কর্মসূচিকে তিনি আন্দোলন বলতে চান না।

তিনি বলেন: এটা আসলে আন্দোলন না, এটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রত্যেক সহকারি শিক্ষকের হতাশা জানানো ও সেটা নিরসনে প্রাণের দাবি। একটি প্রাথমিক স্কুলে আমি সারাদিনে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি নতুন শব্দ শেখাই, সরাসরি জাতিকে শেখাই আমরা। আমরা সারাদিন এজন্য শ্রম দেই। কিন্তু আমরা প্রধান শিক্ষকের পদের বিপরীতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের বৈষম্যের কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে না। আমরা শিক্ষক সমাজ, জাতি গড়ার কারিগর, আমরা কেন আজ রাজপথে থাকবো?

প্রাথমিকের শিক্ষকেরা স্কুল ছুটির সময়ে নিজেদের দাবিতে অনশনে আছেন। আপাতত প্রাথমিক স্কুলগুলোতে স্থবিরতা নেই। কিন্তু নতুন বছরে নতুন বই বিতরণের কী হবে?

এমন প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন: শিক্ষকরা মর্যাদা নিয়ে টিকতে এখন শহীদ মিনারে, না খেয়ে আছে। বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ না নেয়া পর্যন্ত আমরা অনড় থাকবো। শিক্ষকরা অনশনে, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলে বই উৎসবে থাকবেন কিভাবে?

গতকাল শনিবার সকাল ১০টা থেকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। রাতেও শিক্ষকেরা শহীদ মিনারে অবস্থান করেছেন।

বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক মহাজোটের ডাকে এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সহকারী শিক্ষকদের আটটি সংগঠন এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে।