হিরো আলম ও নাগরিক মধ্যবিত্তের মনের গরীবি
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : একজন হিরো আলমকে নিয়ে নাগরিক জীবনে এখন তোলপাড় অবস্থা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক এবং ইউটিউবে ঝড় তুলেছেন তিনি। বগুড়ার এই হিরোর আসল নাম আশরাফুল আলম। পেশায় একজন ক্যাবল অপারেটর ব্যবসায়ী। তার পুরো নামটি হারিয়ে গেছে হিরো আলম নামের মাঝে। সবার কাছে এখন তিনি সুপার হিরো আলম।
তিনি উত্তম কুমারের মতো সুপুরুষ বা বাঙালি নায়কদের মতো ভুড়িওয়ালা, মেদ সর্বস্ব নন। তবুও তিনি নিজের মতো করে মিউজিক ভিডিও বানিয়েছেন, মডেল হয়েছেন। নিজের রাজ্যে রাজকুমারের মতোই যা ইচ্ছে হয়েছে করেছেন। কারোর ধার ধারেননি। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান অনেক খাটুনি খেটে আজ স্থানীয়ভাবে সফল। জীবনে যা স্বপ্ন ছিল তা কোনোদিন হয়তো পূরণ করতে পারেননি, কিন্তু নিজের মতো তার ভুবনকে সাজিয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন- ‘বড়ো ভাবনার ঐশ্বর্যেই মানুষের মনের গরীবি ঘুচে।’ যে হিরো আলম আজ শহুরে মধ্যবিত্তের ঠাট্টা মসকরার বিষয়, তার ভাবনার ঐশ্বর্যকে তার প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না যে তিনি তার নিজস্ব ভুবনের সফল পুরুষ।
কঠোর পরিশ্রম মানুষকে সাফল্য এনে দেয়। হিরো আলমের জীবনও তেমনি পরিশ্রমপূর্ণ ছিল। কারো কাছে হাত না পেতে সাফল্য এসেছে তার জীবনে, যেমন আসে আরো হাজারো মানুষের। সফল মানুষের আনেক শখ জন্ম নেয়। নাগরিক মানুষ অর্থবিত্ত হলে যেমন ক্লাব আর রেস্তোরাঁর ঝলমলে পরিবেশ পছন্দ করতে শুরু করেন, তেমনি হিরো আলমের শখ হয়েছে মডেল হতে। আবার তিনি এতটাই স্বাধীনচেতা যে তিনি নিজেই নির্মাণ করেছেন তার মিউজিক ভিডিও।
কিন্তু শহুরে মধ্যবিত্ত তাকে নিয়ে হাস্যরস করে। সামাজিক মাধ্যম ভাইরাল হয়ে গেছে তার মিউজিক ভিডিও। কিন্তু যারা হাসাহাসি করছে তারা কি একবারও ভাবছেন যে, হিরো আলম যা করেছে তা আসলে সমাজ থেকেই নেয়া। গ্রামীণ সমাজের এই তরুণ শহর দেখে বিমোহিত হয়, রুপালী পর্দার বা টেলিভিশনে চলচ্চিত্রের রঙিন জগত তাকে টানে। সে মডেল হতে চেয়েছে। কিন্তু তার সেই দক্ষতা নেই, চেহারা নেই, নেই শুদ্ধ উচ্চারণ, নেই তার নাচের দক্ষতাও। ভাল চেহারা না হলেও কিভাবে মেকআপ দিয়ে বদলে ফেলা যায় চেহারা তাও জানে না সে। তার কাছে পাউডারই ভরসা। আর গানের সাথে সাথে নারী মডেলের সাথে সে যা করে তা শেষ পর্যন্ত কৌতুকে পরিণত হয়।
কিন্তু একটি বিষয় এখানে বলা দরকার, আর তা হলো এই হিরো আলমের স্বপ্ন পূরণের অদম্য আগ্রহ আছে। সে নিজের চেষ্টায় সফল হয়ছে আর্থিকভাবে, এখন তার প্রচেষ্টা নিজের জগতে নিজের মতো কিছু করা। আমাদের মনস্তত্বে একটা বিষয় খুব শক্তিশালী ভাবে বিরাজ বরে যে, স্বপ্নের রচয়িতা হবে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত ইন্টেলেকচুয়াল। এই চেতনা মহানগরেই বন্দী থাকে না, ছড়িয়ে পড়ে অন্য নগরে, মফস্বলে এমনকি গ্রামে। বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেণি, স্বপ্নবাজ মানুষ মাত্রেই শ্রেণিকে দেখে। কিন্তু স্বপ্ন সফল হয় প্রান্তেও, শুধু কেন্দ্রে নয় সেটা হিরো আলমের মতো করে হলেও।
অধিকার ও সুযোগের সাম্য সমাজে নেই। তাই চাইলেও একজন তার মনের মতো কিছু করতে পারে না। অন্তহীন দারিদ্র্য ব্যক্তির জীবনে এমন হীনমন্যতা তৈরি করে রেখেছে যে, অবস্থা ভালো হলেও গরীবই থেকে যায়- মনের দিক থেকে। ঈর্ষা, অবিশ্বাস, ক্ষুদ্র স্বার্থের পাহারাদারী, কলহ, কোন্দল কেবল যে কাজ হয়ে দাঁড়ায় তা নয়, প্রধান বিনোদনেও পর্যবসিত হয়। সেই বৃত্ত থেকে নিজেকে বের করে আনতে চেয়েছে হিরো আলম।
কামরার ভেতরে যদি আলো বাতাস না প্রবেশ করে তাহলে কামরাটি শুধু অন্ধকারাচ্ছন্নই হবে না, লোকে হোঁচট খাবে। লোকে জানবে না কামরার ভেতরে কোথায় কি আছে। স্বচ্ছতার মধ্য দিয়েই দায়বদ্ধতা আসে। হিরো আলম তার জায়গা স্বচ্ছ। আজকে দেশের প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ দেশের বাইরে রয়েছেন। তারা গ্রামগঞ্জের মানুষ। তারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন বহু উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের নাগরিক স্বপ্ন।
এই সব বাঙালির একটা স্বপ্ন আছে যার যার মতো করে। দেশের বাইরে আর দেশে থাকা অসংখ্য গ্রামীণ মানুষই আমাদের স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছে। তাদের প্রকাশ নাগরিক মানুষের মতো হয়তো কপট নয়, আধুনিক নয়, কিন্তু তারাই স্বপ্নবাজ। তাদের কারণেই বাংলাদেশ আজ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, সামনের স্বপ্ন মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া।
আসলে বাঙালি মাত্রই ভাববাদী কিংবা ভক্তিবাদী। নানা প্রকার ভাবজনিত ও ভক্তিজনিত প্রকাশেই বাঙালির আগ্রহ। তারা ভাবে থাকে, আর ক্ষমতাবানদের কুর্নিশ করে। হিরো আলম না হয়ে বড় রাজনীতিকের সন্তান হলে তাকে তারা বাহবা দিত। আর যেহেতু অধিকাংশই কর্ম থেকে দূরে, তাই তারা ভাব ও ভক্তির চর্চা করে, যে চর্চায় কায়িক শ্রম লাগে না। বসে বসেই যারা অনেক কিছু পেয়ে যায় পারিবারিক আর প্রাতিষ্ঠানিকতার জোরে তারা বাকি সকলকেই উপেক্ষা করে, অবজ্ঞা করে। কাজই বাংলার মানুষের পক্ষে শ্রেয় এবং সেটাই করছে গ্রামীণ মানুষ। সেটাতেই তার মনঃসংযোগ। তাই কাজের পর সে যদি কিছু করে তাকে তার মতো করতে দেয়াই উচিৎ। বাঙালির সম্মান প্রদর্শনে সমস্যা আছে। তবে জেনে রাখা দরকার যে আত্মপ্রকৃতির বিপরীতে গিয়ে সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে হৃদয়ের অনাবিল প্রকাশ থাকে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন