হেফাজত ইসলাম কি আওয়ামী লীগের ভোট বাড়াবে?
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কওমিদের ‘শোকরানা মাহফিল’-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয়া হয়েছে৷ সেখানে হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা শাহ আহমদ শফিকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়ার দাবিও জানানো হয়৷
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন আল-হাইআতুল উলিয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের উদ্যোগে ওই মাহফিলে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা আহমদ শফি৷ প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ মাওলানা আহমদ শফি হেফাজতে ইসলামের আমীর, কওমি শিক্ষা বোর্ডের চেয়াম্যান ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক৷ কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সরকারি স্বীকৃতি এবং দাওরায়ে হাদিসকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান করায় প্রধানমন্ত্রীকে সম্মাননা জানাতেই ওই শোকরানা মাহফিলের আয়োজন করা হয়৷ তবে এখনো অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে কওমি শিক্ষার মান নির্ধারণ করা হয়নি৷ মাহফিলে সারাদেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্ররা অংশ নেন৷ আর সে কারণে রবিবার সারাদেশের জেএসসি এবং জেডিসি পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়৷
বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম মূলত কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষক, ছাত্র ও অনুসারীদের সংগঠন৷ এই সংগঠনটি সরাসরি রাজনৈতিক দল না হলেও তাদের নেতারা বিভিন্ন ইসলামি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত৷ হেফাজত নারী নেতৃত্বকে ‘হারাম’ মনে করে৷ নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করে হেফাজতের আমীর মাওলানা আহমেদ শফি এর আগে সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই ঘটনায় আগে তাঁর সমালোচনা করেছেন৷ হেফাজত সরকারের নারী উন্নয়ন নীতিমালারও বিরোধী৷ এ কারণে সেই নীতিমালা কার্যকর করা যায়নি৷
হেফাজতে ইসলাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরের ঘটনায়৷ তারা ওই সময় সারাদেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক এবংছাত্রদের ঢাকায় এনে সমাবেশের নামে ১২ ঘণ্টার মতো শাপলা চত্বর দখল করে রেখেছিল৷ ১২ ঘণ্টা ধরে সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং সংঘর্ষে তখন কমপক্ষে ৩৯ জন নিহত হয়৷ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তখন তাদের ১৩ দফা দাবিতে শাপালা চত্বরে শান্তিপূর্ন সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল৷
এর আগে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে ‘নাস্তিকদের আন্দোলন’ বলে অভিহিত করে এবং শাহবাগে গিয়ে গণজাগরণ মঞ্চ দখলের ঘোষণা দেয় হেফাজতে ইসলাম৷ ৫ মে তারা শাহবাগ দখলের চেষ্টাও করে৷ বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি তখন হেফাজতে ইসলামের পাশে দাড়াতে সবার প্রতি আহ্বান জানায়৷ পরে তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে টিকতে পারেনি৷ তবে হেফাজতে ইসলাম শাপলা চত্বরের ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করে৷
ওই ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের প্রায় সাড়ে তিন হাজার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা হয়৷ হেফাতের অনেক সিনিয়র নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এখন অবশ্য তাঁরা সবাই জামিনে মুক্ত৷ আর মামলাগুলো নিয়েও তেমন কোনো তৎপরতা নেই সরকারের৷ শাপলা চত্বরের সমাবেশে যোগ দিতে মাওলানা আহমদ শফি ওই দিন ঢাকা এলেও তিনি সমাবেশে যোগ দেননি৷ পরের দিন তিনি চট্টগ্রাম চলে যান৷
তবে গত পাঁচ বছরে সরকার হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়েছে৷ গত বছরের ২০ এপ্রিল গণভবনে মাওলানা আহমদ শফি ৩০০ কওমি আলেম নিয়ে প্রথম প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেন৷ ওই বৈঠকেই কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী৷ তবে এই প্রক্রিয়া আগেই শুরু হয়৷ শাপলা চত্বরের ঘটনার পর সরকারের চট্টগাম এলাকার অধিবাসী একজন মন্ত্রী, সরকারের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা এবং একজন প্রভাবশালী কওমি মাওলানা সরকারের সঙ্গে হেফাজতের, বিশেষ করে মাওলানা আহমদ শফির দূরত্ব ঘুচিয়ে কাছাকাছি এনে দেন৷ রবিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কওমিদের ‘শোকরানা মাহফিল’-এর মাধ্যমে তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটলো৷ আর একদা বিরপরীত মেরুর হেফাজতের সঙ্গে সরকার ও আওয়ামী লীগের এই সখ্য এবং এর পরিণতি নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যকওমি দাওরায়ে হাদিসকে মাষ্টার্স-এরসমমান দিয়েছে৷ তারা রাজনৈতিক কারণে হেফাজতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে৷ কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটিই কাজে দেবে বলে মনে হয় না৷” তিনি বলেন, ‘‘১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে একজন মহিলাও হিজাব পড়েনি৷ আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি৷ কিন্তু এখন হিজাব অনেকেই পড়ছে৷ নানা ধরনের অযৌক্তিক বয়ানের কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ওদের মধ্যে যে আওয়ামী লীগকে সবাই ভোট দেবে, তা আমি মনে করি না৷ হয়তো কিছু লোক দিতে পারে৷ তবে এর মধ্যে অনেক হিসাব বা কৌশল থাকতে পারে, যা এখনই বোঝা যাবে না৷”
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ধর্ম থেকে রাজনীতি বা রাজনীতি থেকে ধর্ম আলাদা করা সম্ভব নয়৷ একটির ওপর আরেকটির প্রভাব থাকে৷ এখন কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করে সেটা দেখার বিষয়৷ বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্ম অতীতে ছিল, এখনো আছে৷ তাই হেফাজতের সঙ্গে সরকারের এই সুসম্পর্কে আমি বিস্মিত নই বা এটা তেমন নতুন কিছু নয়৷”
তিনি বলেন, ‘‘সরকার হয়তো মনে করে তারা কওমি শিক্ষা ব্যবস্থাকে এই সরকারি স্বীকৃতির মাধ্যমে পরিবর্তন আনবে৷ আবার কওমিরা হয়তো মনে করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা চিন্তা সরকারের নীতিতে প্রভাব ফেলবে৷ আসলে কী হবে তা বলার সময় এখনো আসেনি৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘ভোটের আগে সব রাজনৈতিক দলই চায় এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে৷ দল ভারি করতে চায়৷ এখানেও তাই করা হয়েছে৷ আর এ কারণে নির্বাচনের আগেই তা করা হয়েছে৷ এতে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন বা ভোটের হিসাব কী হবে তা বলা যায় না৷”
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখেই কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি এবং হেফাজতের সঙ্গে সখ্য বাড়িয়েছে৷ মান নিশ্চিত না করেই দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টর্স-এর সমমান করেছে৷ এটা বাস্তবভিত্তিক হয়নি৷ আর কোনো শিক্ষা ব্যবস্থাই সরকারের নিয়ন্ত্রনের বাইরে রাখা উচিত নয়৷”
তিনি বলেন, ‘‘শাপলা চত্বরের ঘটনায় এই হেফাজতের বিরুদ্ধে অনেক নাশকতার মামলা হয়েছে৷ হত্যা মামলা হয়েছে৷ আমরা দেখছি এখন সুসম্পর্কের কারণে সেই মামলাগুলোর কেনো তদন্ত হচ্ছে না৷ এটা গ্রহণযোগ্য নয়৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে রাজনীতিতে উগ্রবাদের প্রভাব বাড়বে, যা রাজনীতির জন্য চরম ক্ষতির কারণ হবে৷”
বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় পড়ছে প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী৷ কিন্তু বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি৷ আর মাওলানা শাহ আহম শফির নেতৃত্বে কওমি শিক্ষাবোর্ড সর্ববৃহৎ হলেও এর বাইরে আরো ৫টি কওমি শিক্ষাবোর্ড আছে, যারা স্বাধীনভাবে মাদ্রাসা এবং কওমি শিক্ষা পরিচালনা করেন৷ তবে এখন সবগুলোকে আল-হাইআতুল উলিয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের ছাতার নিচে আনা হয়েছে৷
কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত কোরান, হাদিসভিত্তিক৷ ভাষা হিসেবে আরবী, ফার্সি এবং উর্দূকে প্রাধান্য দেয়া হয়৷ তবে আজকাল প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ইতিহাস, গণিত এবং ভূগোল পড়ানো হয়৷ এই শিক্ষাব্যবস্থাকে কওমি শিক্ষাবিদরা বিশেষায়িত শিক্ষা হিসেবে দেখেন৷ কোরান, হাদিস এবং ফিকাহ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনই এর মূল লক্ষ্য৷ আরবি এবং উর্দূ সাহিত্যও পড়ানো হয়৷
কওমিদের ‘শোকরানা মাহফিল’ ও প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয়ার অন্যতম উদ্যোক্তা এবং উলামায়ে ইসলামের প্রধান মাওলানা ফরিদউদ্দীন মাসউদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটি কমিটি হয়েছিল৷ সেই কমিটি’র আমি সদস্য ছিলাম৷ সেখানে দাওরায়ে হাদীস ছাড়া অন্যান্য শ্রেণির সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার মান কী হবে সে ব্যাপারে সুপারিশ করেছি৷ তবে বাস্তবান হতে সময় লাগবে৷ আর কওমি শিক্ষাকোর্ড মোট ৬টি৷ সবাই যে শিক্ষায় আধুনিকায়ন করছে, তা নয়৷”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তারা এখনো শাপলা চত্বরের ১৩ দফায় অনঢ় আছে৷ তাদের চিন্তা বা অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন আছে বলে আমরা মনে হয় না৷ তাদের ভিতরে এখন শাপলা চত্বরের সেই ঘটনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য আছে৷ কেউ কেউ সেটাকে এখনো গণহত্যা মনে করে৷ হয়তো মাওলানা আহমদ শফির নেতৃত্বের সামনে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য হতে পারছে না৷” আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সরকারি স্বীকৃতি ভোটে কতটুকু প্রভাব ফেলবে তা আল্লাহ ভালো জানেন৷”
-ডয়চে ভেলে
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন