১৭ বিমার দুর্নীতি : ইদরাকে ব্যবস্থার নেওয়ার সুপারিশ
সরকারি-বেসরকারি ১৭ বিমা কোম্পানি অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে দেড় হাজার কোটি টাকা অপচয় বা আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
যে কারণে দুদকের অনুসন্ধান টিম ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটিকে (আইডিআরএ বা ইদরা) বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যদিও কৌশলগত কারণে সরাসরি কোনো ধরনের মামলার সুপারিশ করেনি দুদকের ওই টিম।
কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সদ্য পিআরএলে যাওয়া দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল বলেন, সম্প্রতি কমিশনে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর বিষয়টি মিডিয়াকে বিস্তারিত জানানো হবে।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধানে ব্যবস্থাপনায় অতিরিক্ত ব্যয় হওয়ার সত্যতা মিলেছে। তবে এখনই সরাসরি আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছে না দুদক। এর কারণ হিসেবে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইনস্যুরেন্স আইন অনুসারে যে অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগ উঠেছে তার সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতার মিল নাই। কারণ, বীমা কোম্পানিগুলোর প্রশাসনিক ব্যয় এখনো বেশ আগের রেট অনুসরণ করে থাকে। আর এ বিষয়ে বীমা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইদরাকে অনেকবার চিঠি দিয়েছিল কোম্পানিগুলো। তাদের দাবি, ইদরা এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও দুদকের অনুসন্ধানে অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রমাণ মিলেছে। তাই এ বিষয়ে অনুসন্ধান টিমের ব্যাপারে কমিশনের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
অন্যদিকে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ার আরো একটি কারণে বলা হয়েছে, দুদক আইন অনুযায়ী সরকারি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি মামলার মতো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞায় বেসরকারি বিমা কোম্পানিগুলো পরে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞা অনুসারে বিমা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলতে এমন ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝাইবে, যারা শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি বা গৃহায়ণের জন্য ঋণ বা আগাম প্রদান করে কিংবা সরকার বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা কর্তৃক ইস্যুকৃত শেয়ার, স্টক, বণ্ড, ডিবেঞ্চার বা সিকিউরিটিজ বাজারজাতকরণের উপযোগী অন্যান্য সিকিউরিটিজের দায় গ্রহণ, অধিগ্রহণ, বিনিয়োগ বা পুনঃবিনিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়াও যে প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ইজারাদানসহ কিস্তিবন্ধী লেনদেনের ব্যবসা করে বা মূলধনে অর্থায়ন করে এবং মার্চেন্ট ব্যাংক, বিনিয়োগ কোম্পানি, মিউচ্যুয়াল এসোসিয়েশন, মিউচ্যুয়াল কোম্পানি, লিজিং কোম্পানি অথবা বিল্ডিং সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত হবে।
আর এজন্যই দুদক টিম ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটিকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে। তবে সরকারি বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে অনুসন্ধান প্রতিবেদনে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে কমিশনে এ বিষয়ে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে দুদক সূত্র জানায়।
এ বিষয়ে অনুসন্ধান কাজের তদারককারী কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘অনুসন্ধান টিমের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। এমনকি কমিশন এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কেও আলোচনা করেছে। তবে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিশন আমাদের যে নির্দেশনা দেবে আমরা সে অনুসারে কাজ করবো।
অতিরিক্ত ব্যয়ের নামে বিভিন্ন সময়ে গ্রাহকদের ১ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ১৭ বিমা কোম্পানি। ২০১৬ সালের ২১ জুন এমন অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরপরই দুদকের উপপরিচালক মো. জালাল উদ্দিনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের টিম গঠন করা হয়। টিমের অপর সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন।
বিমা কোম্পানিগুলো হলো, পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, জীবন বীমা করপোরেশন, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ, গোল্ডেন লাইফ, সন্ধানী লাইফ, প্রগতি লাইফ, সানফ্লাওয়ার লাইফ, সানলাইফ, প্রাইম ইসলামী লাইফ, মেঘনা লাইফ, ডেল্টা লাইফ, রুপালী লাইফ, হোমল্যাণ্ড লাইফ, প্রোগ্রেসিভ লাইফ, বায়রা লাইফ এবং ন্যাশনাল লাইফ ইন্সুরেন্স।
দুদক সূত্র জানায়, লাইফ বিমা খাতের সরকারি-বেসরকারি পুরনো ১৭ কোম্পানি ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৯৭৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকের অংশ ৯০ শতাংশ বা ১ হাজার ৭৮০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে কোম্পানিগুলোর দাখিল করা তথ্যে এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইদরা ২০১২ সাল থেকেই ব্যয় কমিয়ে আনতে বেশ কয়েকবার তাগিদ দিয়েছিল কোম্পানিগুলোকে।
সূত্র জানায়, ইদরা’র তথ্যানুসারে অবৈধ ব্যয়ের তালিকায় সবচেয়ে ওপরে থাকা সাতটি কোম্পানি মোট অবৈধ ব্যয় করেছে ১ হাজার ৩৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা মোট অবৈধ ব্যয়ের ৭০ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এর মধ্যে গ্রাহকের রয়েছে ১ হাজার ২৫৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। যে তালিকায় একেবারে ওপরের দিকে রয়েছে পপুলার লাইফ ২৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, জীবন বীমা করপোরেশন ২৭৬ কোটি ৭৬ লাখ টাকা, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ২০০ কোটি ৫১ লাখ টাকা, পদ্মা ইসলামী লাইফ ১৬৬ কোটি ৮৩ লাখ, গোল্ডেন লাইফ ১৬৫ কোটি ২৫ লাখ, সন্ধানী লাইফ ১৫৫ কোটি ৫৯ লাখ, প্রগতি লাইফ ১৪৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করেছে।
এ ছাড়া অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে সানফ্লাওয়ার লাইফ ৯১ কোটি ২৭ লাখ টাকা, সানলাইফ ৯০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, প্রাইম ইসলামী লাইফ ৭৪ কোটি ৪১ লাখ, মেঘনা লাইফ ৬৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ডেল্টা লাইফ ৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা, রুপালী লাইফ ৫০ কোটি ২৩ লাখ, হোমল্যান্ড লাইফ ৪৮ কোটি ৮ লাখ, প্রোগ্রেসিভ লাইফ ৪২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, বায়রা লাইফ ৩৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা ও ন্যাশনাল লাইফ ইনস্যুরেন্স ৭ বছরে ২১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা অবৈধ ব্যয় করেছে। রাইজিংবিডি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন