৩৮ বছরে ছুটিই নেননি শিক্ষক বাহাজ

মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক। একজন শিক্ষকের ধ্যান-জ্ঞান থাকে শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দেশ।

মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ব্রতই প্রকৃত শিক্ষকের কাজ।

এদিকে থেকে টাঙ্গাইলের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাহাজ উদ্দিন ফকির (৬০) সফল।

শিক্ষকতার ৩৮ বছরে তিনি একদিনের জন্যও প্রাপ্য ছুটি ভোগ করেননি। অথচ এই মহান ব্যক্তির জীবনে এসেছে বুধবার, শেষ কর্মদিবস। এরপর থেকে বাহাজ উদ্দিনকে আর ছুটি নিয়ে ভাবতেই হবে না।

ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ এই মহান শিক্ষক ৩৮ বছরে নিজেকে উজাড় করে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুক্রবার ও নির্দিষ্ট ছুটি বাদে প্রতিদিনই তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত থেকেছেন।

এমনকি বাবার মৃত্যু, নিজের বিয়ে, স্ত্রীর অসুস্থতা, সন্তানের জন্ম, পারিবারিক সমস্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ- কোনো কিছুই বাহাজ উদ্দিনের বিদ্যালয়ে আসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

এজন্য বাহাজ উদ্দিনকে তার বিদ্যালয় সম্মানিত করেছে, পুরস্কার দিয়েছে। এসব ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

বাহাজ উদ্দিন ফকির কাছে ছুটিহীন ৩৮ বছরের স্মৃতিচারণ করেছেন। কথা বলার সময় তিনি বারবার ফিরে যাচ্ছিলেন পেছনের দিকে।

স্মৃতি রোমন্থনে বাহাজ ফকির জানান, মধুপুর উপজেলার গোপদ গ্রামে কৃষক পরিবারে ১৯৫৭ সালের ১ জুন তার জন্ম। টানাটানির সংসার বলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় টিউশনি শুরু করেন।

পরিবার ও নিজের খরচ যোগাড়ের মাধ্যমে খুব কষ্টে ১৯৭৩ সালে মধুপুর রাণী ভবানী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৭৫ সালে মধুপুর কলেজ থেকে এইচএসসি ও ১৯৭৭ সালে ধনবাড়ী ডিগ্রি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন তিনি।

১৯৭৯ সালে ২২ বছর বয়সে বাহাজ ফকির তৎকালীন শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৮৮ সালে বিএড করেন। পরে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে সিপিডি-১ ও সিপিডি-২ প্রশিক্ষণ নেন।

১৯৯০ সালের কথা, ঈদের ছুটিতে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার গুণারীতলা গ্রামের মরহুম কাদের চেয়ারম্যানের মেয়ে শামসুন্নাহারের সঙ্গে তার বিয়ের আয়োজন হয়।

বিয়ে হওয়ার পর পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতায় বিদ্যালয় চালুর পরের দিন শ্বশুর বাড়িতে অনুষ্ঠান। বিদ্যালয়ের চার ক্লাস পর ছুটি নিয়ে বাহাজ চললেন শ্বশুর বাড়ি। রাত ১২টায় পৌঁছে ভোরে আবার ফিরতি যাত্রা স্কুলের পথে।

বেলা ১১টায় এসে ক্লাস ধরেছেন। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ের কোনো এক শুক্রবার, স্ত্রী শামসুন্নাহার সন্তানসম্ভবা। তাকে নিয়ে পরের দিন কাক ডাকা ভোরে বাহাজ মধুপুর ফিরবেন। উদ্দেশ্য, বিদ্যালয়ে ক্লাস ধরা।

হঠাৎ শুনলেন, হরতাল না কি যেন কারণে যান চলাচল বন্ধ। শ্বশুরালয় থেকে একটি সাইকেল নিয়ে তার পেছনে স্ত্রীকে বসিয়ে ছুটলেন বাহাজ। ছুটছেন তো ছুটছেন আর ঘড়ি দেখছেন। পথ যেন ফুরায় না। ততক্ষণে সকাল ১০টা বেজে গেজে। ১১টায় তার ক্লাস। সাইকেলের গতি বাড়ালেন বাহাজ, ১১টার কাছাকাছি সময়ে স্ত্রীকে রিকশায় বাড়ির পথে তুলে দিয়ে তিনি কয়েক মিনিট আগেই ক্লাসে পৌঁছান।

বাহাজ উদ্দিন জানান, প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছিল শ্বশুরালয়ে এবং সেটি বিদ্যালয় চালুর দিনে। শুক্রবারের অপেক্ষায় থেকে তিনি সন্তানের মুখ দেখেন।

বাবা আব্দুল হামিদ ফকির ২০০৩ সালের ২৭ জুন মারা যান, সেদিন ছিল শুক্রবার। কিন্তু কর্তব্যপরায়ণ এই শিক্ষক শোক মাথায় নিয়ে পরের দিনই ক্লাসে পড়িয়েছেন।

জীবনের এসব স্মৃতি আজ বাহাজ ফকিরকে বড্ড স্পর্শ করছে। তিনি জানান, শিক্ষকতা শুরুর বছর বিদ্যালয়ের অপর দুই শিক্ষক শেখ আব্দুল জলিল ও আব্দুর রশিদ সারা বছরে এক দিনও ছুটি না ভোগ করায় পুরস্কৃত ও সম্মানিত হন। তা থেকেই উদ্ধুদ্ধ হই।

তিনি বলেন, আজ তাকেই অনেকে অনুসরণ করছেন। তার তিন সন্তানও অনুপস্থিত না থাকার প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে গেছে। সহকর্মী ও কর্মচারীরা অনুসরণ করে পুরস্কার গ্রহণ অব্যাহত রেখেছেন।

একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাহাজ উদ্দিন বলেন, গণমাধ্যমে আমাকে নিয়ে খবর দেখে খুলনার শিক্ষানুরাগী (বর্তমানে রাজধানীর বাসিন্দা) ও ব্যবসায়ী কুতুব উদ্দিন দেখা করতে ছুটে আসেন। সেদিন তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার সামগ্রী ও চকলেট আনেন।

পরে কুতুব উদ্দিন বাহাজ ফকিরের মাধ্যমে পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ শহীদ স্মৃতির সংস্কার কাজ করে দেন। দুই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীকে স্কুল ব্যাগ ও টিফিন বক্স উপহার দেন।

কানাডা প্রবাসী দেলোয়ার হোসেন শাবান ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শর্মিলা আহমেদের কাছ থেকে কুতুব উদ্দিন ওই দুই বিদ্যালয়ে দু’টি কম্পিউটার ল্যাবরেটরি নির্মাণসহ আসবাব উপহার দেন। এভাবে কুতুব উদ্দিন প্রায় ২৫ লাখ টাকা শিক্ষাখাতে ব্যয় করেন মূলত বাহাজ ফকিরের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ হয়ে।

তবে এখানেই কুতুব উদ্দিন ক্ষ্যান্ত হননি। তিনি খুলনার কসবায় এক শিক্ষক সমাবেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাহাজ উদ্দিনকে নিয়ে গিয়ে সম্মানিত করেন। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে মাগুরার নোমানী ময়দানে বিশেষ আলোচক হয়েও যোগদান করেছেন এই শিক্ষক।

মাগুরার আমুরিয়ায় ডা. আবুল কাশেম শিক্ষা ফাউন্ডেশন বাহাজ ফকিরকে সংবর্ধনা এবং আজীবন সদস্য পদ দিয়েছে। এটি পেয়ে গর্বিত বাহাজ।

৩০ বছরের শিক্ষকতা জীবনের হিসাব থেকে প্রাপ্য ৬০০ দিনের ছুটি ভোগ না করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বাহাজ উদ্দিন। ৭৬০ দিনের প্রাপ্য ছুটির একদিনও তিনি ভোগ করেননি।

এ বিষয়ে বাহাজ ফকিরের বক্তব্য, ‘দেশকে এগিয়ে নিতে ওই ছুটির দিনগুলোকে আমি ব্যবহার করা প্রয়োজন মনে করেছি।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মনে করতে চাই না, আজ আমার কর্মজীবনের শেষ দিন। শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি, এজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া।’

বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ বজলুর রশিদ খান বলেন, ‘বাহাজ উদ্দিন ফকিরের এ ত্যাগ সত্যি বিরল ও অনুসরণ যোগ্য। তার অবদান বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।’