৪০ রোহিঙ্গাকে সমুদ্রে ফেলে দিলো ভারত : এপির প্রতিবেদন

ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে আটক ৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই ঘটনায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে- যাদের সমুদ্রে ফেলা হয়েছে, তাদের মধ্যে কিশোর-কিশোরী, বৃদ্ধ এবং বিভিন্ন গুরুতর রোগে আক্রান্ত মানুষও ছিলেন।
ভুক্তভোগীদের স্বজনদের দাবি, দিল্লি পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, শুধুই বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হবে। কিন্তু এরপর আর কেউ ঘরে ফেরেনি।
আমিনা (ছদ্মনাম) নামের এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, আমার ভাই আমাদের গ্রাম পুড়ে যাওয়ার পর ভারতে এসেছিল। পথে বাবা-মাকে কবর দিয়ে এসেছিল সে। দিল্লি পুলিশ বলেছিল শুধু বায়োমেট্রিক নেবে, বিশ্বাস করে সে চলে যায়। তারপর আর আমার ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই।
উল্লেখ্য, এই রোহিঙ্গারা সবাই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) নিবন্ধিত শরণার্থী ছিলেন। ৬ মে রাতে দিল্লির উত্তম নগর, বিকাশপুরি ও হাসতসাল এলাকা থেকে তাদের তুলে নেওয়া হয়।
প্রথমে তাদের ইন্দরলোক ডিটেনশন সেন্টারে নেওয়া হয়, এরপর ৮ মে একটি ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে করে আন্দামান পৌঁছে দেওয়া হয়। অভিযোগ, সেখান থেকে একটি নৌযানে করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় নিয়ে তাদের একে একে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়।
শুক্রবার (১৬ মে) এপি (এসোসিয়েটেড প্রেস) ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যার এ সংক্রান্ত প্রকাশিত পৃথক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
প্রতিবেদনে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার আইনজীবীরা জানান, আটক ব্যক্তিদের আইনের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতে পেশ করা হয়নি, যা ভারতের সংবিধান লঙ্ঘন করে।
ইউএনএইচসিআরের আইন কর্মকর্তা দিলোয়ার হোসাইন বলেন, তাদের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা করা হয়েছে। কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা আদালতে উপস্থাপনের ব্যবস্থা ছিল না। এমনকি নারীদের ক্ষেত্রে কোনো স্পেশাল জুভেনাইল পুলিশ ইউনিটও (এমন একটি বিশেষায়িত পুলিশ ইউনিট, যেটি শুধু শিশুদের ১৮ বছরের নিচে, সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য গঠিত হয়) ছিল না।
তিনি আরও জানান, এক নারীর স্বামীকে তুলে নেওয়া হয়, যিনি সদ্য গর্ভপাতের শিকার হয়েছিলেন। আরেক নারী অভিযোগ করেন, তিনজন পুলিশ মদ্যপ অবস্থায় তার বাড়িতে ঢুকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে।
প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, পরবর্তীতে ওই ৪০ জনকে চোখ বেঁধে, হাত-পা বেঁধে পোর্ট ব্লেয়ারে বিমানযোগে পাঠানো হয়। এরপর ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় নেওয়া হয় এবং সেখান থেকে একে একে জলে ফেলে দেওয়া হয়।
যাত্রাপথে তাদের জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা ইন্দোনেশিয়া যেতে চাও, না মিয়ানমার? তারা জানায়, মিয়ানমারে ফিরলে নির্যাতনের শিকার হবে। কিন্তু এই অনুনয় অগ্রাহ্য করে বলা হয়- কারও না কারও জাহাজ এসে তুলে নেবে।
কিন্তু কেউ তুলে নেয়নি। পরে ওই রোহিঙ্গারা নিজেরাই প্রায় ১২ ঘণ্টা সাঁতরে মিয়ানমারের তানিনথারি অঞ্চলে পৌঁছান।
প্রসঙ্গত, ভারত সরকার দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, তারা ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের স্বাক্ষরকারী নয়। তবে ‘কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার’-এর স্বাক্ষরকারী হিসেবে ভারতের এমন পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিনিয়র আইনজীবী কলিন গনসালভেস বলেন, এই শরণার্থীদের মিয়ানমার সরকার কখনো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাহলে ভারত কীভাবে তাদের ফেরত পাঠায়? এটা শুধু আইনগত নয়, নৈতিক প্রশ্নও।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, তারা কি কেবল মুসলমান বলেই এমন আচরণের শিকার? তার মতে, এই মানুষদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের অভিযোগ নেই, তারা সন্ত্রাসীও নন।
রোহিঙ্গা তরুণ রিফান (ছদ্মনাম) বলেন, আমার চাচাতো ভাই ছিল ভালো মানুষ। রাজনীতি থেকে দূরে থাকত। তাকে আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলা হয়েছে। জানিও না, সে বেঁচে আছে কিনা।
জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা এখন তাদের মিয়ানমার ইউনিটের মাধ্যমে ওই ৪০ জনের অবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। তবে আইনজীবীরা জানান, এই ঘটনার পর থেকে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি বিচারাধীন থাকায় এ বিষয়ে সরকারিভাবে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন